Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

শবে মেরাজের শিক্ষা

islam

মুসলিম জীবনের তিনটি পবিত্র রজনীর মধ্যে লাইলাতুল মেরাজ অন্যতম। অন্য দু’টি হলো লাইলাতুল কদর ও লাইলাতুল বরাত। এর মধ্যে লাইলাতুল মেরাজ ও লাইলাতুল কদরের কথা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ আছে। মেরাজ রাসূল সা:-এর অন্যতম মুজেজা বা অলৌকিক ঘটনা।

chardike-ad

হিজরতের কিছু দিন আগে মেরাজের সুমহান ঘটনাটি ঘটে নবীজীবনে। একটি সৃজিত জাতির জাগতিক ও পারলৌকিক মঙ্গলের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের বাস্তব প্রশিক্ষণই ছিল এই মহামিলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো রাসূল সা:-কে এই রজনীতেই অবহিত করা হয়। বস্তুত মেরাজই হলো ইসলামি গতিধারার মূল উৎস। তাই মুসলিম জাতিসত্তার জন্য নবীজীবনের মেরাজ এক তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়।

ইসরা: মসজিদে হারাম বা কাবা শরিফ থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত ভ্রমণকে ইসরা বলা হয়। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, ‘পবিত্র তিনি, যিনি তাঁর বান্দাহকে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত ভ্রমণ করিয়েছেন। তাঁর চার দিক আমি বরকতময় করেছিলাম তাঁকে আমার কুদরতের নিদর্শন দেখানোর উদ্দেশ্যেই। নিশ্চয়ই তিনি স্বপ্নদ্রষ্টা’ (সূরা বনি ইসরাইল : ১)।

মেরাজ: মেরাজ শব্দের অর্থ সিঁড়ি বা ধাপ, যার মাধ্যমে ওপরে ওঠা যায়। মসজিদে আকসা থেকে সপ্ত আসমান পর্যন্ত ভ্রমণকে মেরাজ বলা হয়। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই তিনি (মুহাম্মদ) তাকে (জিব্রাইল আ:-কে) আরেকবার দেখেছিলেন সিদরাতুল মুনতাহার নিকটে, যার কাছেই রয়েছে বসবাসের জান্নাত। তাঁর দৃষ্টিবিভ্রম হয়নি এবং তিনি সীমালঙ্ঘনও করেননি। নিশ্চয়ই তিনি তাঁর পালনকর্তার মহান নিদর্শনাবলি অবলোকন করেছেন’ (সূরা নজম : ১৪-১৭)।

শবে মেরাজের উদ্দেশ্য: তাওহিদের নির্দেশাবলি আল্লাহর আয়াতগুলোর বাস্তবিক চাক্ষুষ প্রমাণ দেখিয়ে দেয়ার জন্য এবং এই বিশ্বের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব যে মহান আল্লাহরই, তা সরাসরি দেখানোই মেরাজের উদ্দেশ্য। তার এই মতাকে চ্যালেঞ্জ করার কেউ নেই। অতএব, তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে দ্বীনের বিজয় ঠেকানোর সাধ্য কারো নেই। এই আস্থা ও বিশ্বাস মজবুত ও সুদৃঢ় করাই মেরাজের মূল ল্য। আল্লাহ তায়ালার একান্ত সান্নিধ্যে হাজির হওয়া, ঊর্ধ্বলোক সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করা, অদৃশ্য ভাগ্যলিপি সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করা, ইহকাল, পরকাল, নভোমণ্ডল, বেহেশত, দোযখ সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করাও মেরাজের অন্যতম উদ্দেশ্য। সর্বোপরি মদিনার ভাবী ইসলামি রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দেয়ার উপযোগী করে গড়ার উদ্দেশ্যেই মহান স্রষ্টা তার প্রিয় নবীকে সান্নিধ্যে টেনে নিয়েছিলেন।

মেরাজের সংপ্তি বিবরণ: বেশির ভাগ ওলামায়ে কেরামের মতে নবুয়্যতের দ্বাদশ সালে ২৭ রজব সোমবার রাতের শেষার্ধে রাসূল সা: তাঁর দুধ বোন উম্মে হানি বিনতে আবু তালিবের ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এমন সময় আল্লাহর হুকুমে হজরত জিব্রাইল আ: একদল ফেরেশতাসহ এসে মহানবী সা:-এর সিনা চিরে হাউজে কাউসারের পানি দ্বারা গোসল করিয়ে জান্নাতি পোশাকে নবীজীকে সুসজ্জিত করে আল্লাহর দিদারের কথা জানালে রাসূল সা: স্বতঃস্ফূর্ত চিত্তে রাজি হন। এরপর বোরাক যোগে মক্কা থেকে বায়তুল মুকাদ্দাসের দ্বারে উপনীত হন। সেখানে উপস্থিত লাখ লাখ নবী-রাসূল ও ফেরেশতারা তাঁকে অভিবাদন জানান এবং তাঁর পেছনে নামাজ পড়েন।

অতঃপর তিনি সপ্ত আকাশ পরিভ্রমণ করেন। সেখানে প্রথম আকাশে হজরত আদম আ:, দ্বিতীয় আসমানে হজরত ইয়াহিয়া আ:, তৃতীয় আসমানে হজরত ইউসুফ আ:, চতুর্থ আসমানে হজরত ইদ্রিস আ:, পঞ্চম আসমানে হজরত হারুন আ:, ষষ্ঠ আসমানে হজরত মুসা আ:, সপ্তম আসমানে হজরত ইব্রাহিম আ:-এর সাক্ষাৎপর্ব শেষ করে তিনি সিদরাতুল মুনতাহায় পৌঁছেন। এখানেই রাসূল সা: হজরত জিব্রাইল আ:-কে স্বচে দেখেন। সেখানে দিগন্ত বেষ্টিত সবুজ রঙের রফরফ (গদিবিশিষ্ট আসন) আসে এবং তিনি রফরফে চড়ে সত্তর হাজার নূরের পর্দা পার হয়ে আরশে আজিমে উপস্থিত হন। সেখানে তিনি আল্লাহ পাককে সিজদা করেন এবং সেখানেই সরাসরি আল্লাহর সাথে তার কথা হয়। অতঃপর তিনি বায়তুল মুকাদ্দাসে ফিরে আসেন।

শবে মেরাজের তাৎপর্য: ইসলামের ইতিহাসে মেরাজ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। যখন সব দিক থেকে রাসূল সা: মারাত্মক সঙ্কট ও শোকের সম্মুখীন হয়েছিলেন, সেই দুঃসময়ে আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় হাবিবকে তাঁর সান্নিধ্য লাভের সুযোগ দিয়েছিলেন। পার্থিব জীবনের অভিভাবক চাচা আবু তালেবের মৃত্যু, প্রাণপ্রিয় সহধর্মিণী উম্মুল মুমেনিন হজরত খাদিজা রা:-এর ইন্তেকাল, তায়েফের হৃদয়বিদারক ঘটনা, মক্কার কাফেরদের অমানবিক আচরণ, নির্যাতনসহ বিভিন্ন অনাকাক্সিত ঘটনা রাসূলুল্লাহ সা:-এর জীবন বিপন্ন ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। মেরাজের মাধ্যমে তাঁকে জানিয়ে দেয়া হয় রাতের পরই আছে ভোর। ইসলামের বিজয় সমাগত, যার জন্যই তিনি সংগ্রাম করছিলেন। সাথে সাথে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাকে পূর্ণতা লাভের সবকও দান করেছিলেন। আল্লাহ তাকে আলমে বারযাখ, জান্নাত, জাহান্নাম, লওহে কলম, আরশ-কুরসি, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের সব কিছু প্রত্য করান এবং অনন্ত রহস্যের ভাণ্ডার তার সামনে উন্মুক্ত করে দেন।

সেই রাতেই আল্লাহর কাছ থেকে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের হুকুম জারি করা হয়। প্রথমে ৫০ ওয়াক্ত সালাতের নির্দেশ দেয়ার পর রাসূল সা: তাঁর উম্মতের দিকে তাকিয়ে আল্লাহর কাছে কাকুতি-মিনতি করেন এবং অতঃপর আল্লাহ তায়ালা পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের বিধান করেন এবং পাঁচ ওয়াক্তকে পঞ্চাশ ওয়াক্তের সমতুল্য করে দেন।
মেরাজের মাধ্যমেই আরববাসীর সামনে ইসলামি রাষ্ট্রের নীলনকশা পেশ করা হয়। মেরাজ থেকে এসে সমগ্র বিশ্বের সামনে রাসূল সা: সেই নীলনকশা তুলে ধরেন।

শবে মেরাজের প্রকৃত শিক্ষা: রাসূল সা: মেরাজ থেকে ফিরে আসার পর সূরা বনি ইসরাইলের মাধ্যমে ১৪টি দফা জনগণের সামনে পেশ করেন-
১. আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক কোরো না, তাহলে তুমি নিন্দিত ও অসহায় হয়ে পড়বে। আর তোমরা কেবল আল্লাহরই বন্দেগি করো (সূরা বনি ইসরাইল-২২)।
২. বাবা-মার সাথে ভালো ব্যবহার করো। তাদের একজন বা উভয়ে বৃদ্ধ অবস্থায় যদি তোমাদের সামনে উপনীত হয় তাহলে তাদের সাথে উহ্ শব্দটি পর্যন্ত কোরো না। তাদের ধমকের সুরে জবাব দিয়ো না; বরং তাদের সাথে মর্যাদা সহকারে কথা বলো। আর তাদের সামনে বিনয়ী থেকো আর দোয়া করতে থাকো- ‘হে আমার প্রতিপালক, তাদেরকে তেমনিভাবে লালন-পালন করো, যেমনি তারা শৈশবে আমাদের লালন-পালন করেছেন’ (সূরা বনি ইসরাইল ২৩-২৪)।
৩. তোমাদের কৃতকর্মের জন্য আল্লাহর কাছে তওবা কর, তাহলে আল্লাহ তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চই আল্লাহ তোমাদের মনের খবর জানেন (সূরা বনি ইসরাইল-২৫)।
৪. আত্মীয়স্বজনকে তাদের অধিকার দাও আর মুসাফিরদের হক আদায় কর (সূরা বনি ইসরাইল-২৬)।
৫. অপব্যয় কোরো না, নিশ্চয়ই অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই, আর শয়তান স্বীয় প্রতিপালকের প্রতি অকৃতজ্ঞ (সূরা বনি ইসরাইল-২৭)।
৬. হকদারদের হক আদায়ে তুমি যদি অপারগ (অসমর্থ) হও তাহলে তাদের সাথে অত্যন্ত নম্রভাবে কথা বলো (সূরা বনি ইসরাইল-২৮)।
৭. ব্যয়ের ক্ষেত্রে বেহিসাবি হয়ো না, আবার কৃপণতাও প্রদর্শন কর না। আল্লাহ যাকে চান রিজিক বাড়িয়ে দেন, যাকে চান কমিয়ে দেন (সূরা বনি ইসরাইল : ২৯-৩০)।
৮. দারিদ্র্যের ভয়ে সন্তান হত্যা কোরো না। নিশ্চয়ই এটি মহাপাপ (সূরা বনি ইসরাইল : ৩১)।
৯. জেনা-ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চই এটি নিকৃষ্ট ও গর্হিত কাজ (সূরা বনি ইসরাইল : ৩২)।
১০. কোনো জীবনকে অন্যায়ভাবে হত্যা কোরো না। কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হলে তার উত্তরাধিকারীকে আমি এই অধিকার দিয়েছি (চাইলে রক্তের বিনিময় চাইতে পারে), তবে প্রতিশোধের ব্যাপারে সে যেন বাড়াবাড়ি না করে (সূরা বনি ইসরাইল : ৩৩)।
১১. এতিমের সম্পদের ধারেকাছেও যেও না। সম্পদের ব্যাপারে তার বয়োপ্রাপ্তি পর্যন্ত অপো করো আর প্রতিশ্র“তি সম্পর্কে সচেতন থাক। নিশ্চয়ই প্রতিশ্র“তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে (সূরা বনি ইসরাইল : ৩৪)।
১২. ওজনে কখনো কম দিয়ো না। দাঁড়িপাল্লা সোজা করে ধরবে- এটিই উত্তম পন্থা (সূরা বনি ইসরাইল : ৩৫)।
১৩. যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই সেগুলোর পেছনে লেগো না। নিশ্চয়ই চোখ, কান, অন্তর সব কিছুই জিজ্ঞাসিত হবে (সূরা বনি ইসরাইল : ৩৬)।
১৪. জমিনে দম্ভসহকারে চলো না। এগুলো সবই মন্দ ও ঘৃণিত কাজ (সূরা বনি ইসরাইল : ৩৭-৩৮)।

এই ১৪ দফাই শবে মেরাজের প্রকৃত শিক্ষা। শুধু ধর্মীয় বিশ্বাস নয়, বরং যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা রাসূল সা: মদিনায় গিয়ে কায়েম করেছিলেন, এগুলো তার বুনিয়াদি মূলনীতি। পরবর্তীকালে এই দফাগুলো ইসলামি রাষ্ট্রের আইনে পরিণত হয় এবং প্রশাসনিক ক্ষেত্রে এগুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় বিধি-ব্যবস্থা রাসূল সা: প্রণয়ন করেন। ইসলামি হুকুমাত প্রতিষ্ঠার পর মানুষের জীবনধারা সুন্দর ও শান্তিময় হয়ে ওঠে এবং পবিত্র জীবনধারার এক সভ্যতার বিস্তৃতি লাভ করে। মসজিদ, মক্তব, মাদরাসাসহ সর্বোত্র রমরাজের এই শিাকে গুরুত্বের সাথে আলোচনা করে এর আলোকে ব্যক্তি, সমাজ ও দেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করা আমাদের সবার ঈমানি দায়িত্ব। সব ধরনের অশান্তি, পাশবিকতা ও মানব বিপর্যয় থেকে মুক্তির এটিই একমাত্র পথ।