Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

বিদেশেও সবচেয়ে সস্তা বাংলাদেশিদের শ্রম

bangladeshi-labourবাংলাদেশে সবচেয়ে সস্তায় শ্রম মেলে- এ জন্যই বিনিয়োগকারীরা এ দেশে আসেন। এ দেশে থেকে যারা বেশি আয়ের আশায় বিদেশ পাড়ি দেন, তাদের শ্রমও সস্তা। বিশ্বব্যাংকের ‘মাইগ্রেশন অ্যান্ড রেমিট্যান্স ফ্যাক্টবুক-২০১৬’ এর তথ্য অনুযায়ী, রেমিট্যান্স আহরণকারী শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশি কর্মীদের মাথাপিছু রেমিট্যান্সের (দেশে পাঠানো টাকা) পরিমাণ সবচেয়ে কম।

সরকারি হিসাবে বছর বছর রেমিট্যান্স বাড়লেও, অন্য দেশগুলোর তুলনায় পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। সদ্য সমাপ্ত ২০১৫ সালে রেমিট্যান্স আয়ে দশম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। ২০০৯ সালে ছিল অষ্টম স্থানে। গত ৬ বছরে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স আয় প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়লেও অন্য দেশগুলোর আয় বেড়েছে দ্বিগুণ। মাথাপিছু রেমিট্যান্স আয়ে সবার শীর্ষে মিসর। অথচ পাঁচ বছর আগেও দেশটি বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে ছিল।

chardike-ad

রেমিট্যান্স আয়ে শীর্ষ দশে থাকা রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্সের মতো উন্নত দেশগুলোর কর্মীরা প্রবাসে বাংলাদেশ কর্মীদের তুলনায় প্রায় চারগুণ আয় করেন। উন্নয়নশীল দেশ মিসর, মেক্সিকো, ভারতের কর্মীরাও বাংলাদেশের কর্মীদের তুলনায় তিনগুণ থেকে আড়াইগুণ আয় করেন। প্রতিবেশী দেশ নেপাল, শ্রীলংকা ও মিয়ানমারের কর্মীদেরও মাথাপিছু রেমিট্যান্স পাঠানোর পরিমাণ বাংলাদেশি কর্মীদের তুলনায় বেশি।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় বলছে, পেশাগত ও ভাষাগত দক্ষতার অভাবেই বাংলাদেশের কর্মীরা আয়ে অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে। সরকারি হিসাবে, বাংলাদেশি কর্মীদের অর্ধেকই অদক্ষ কিংবা স্বল্প দক্ষ। জনশক্তি খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব সমস্যা আরও এক যুগ আগে চিহ্নিত হয়েছে। তা কাটিয়ে উঠতে উদ্যোগের ঘাটতি ছিল। এ কারণেই এগিয়ে যাচ্ছে অন্য দেশগুলো। বাংলাদেশ ধীরে এগোলেও অন্যদের তুলনায় দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে।

বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার বিষয়টি প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী নূরুল ইসলাম বিএসসিও স্বীকার করেন। তিনি সমকালকে বলেন, ফিলিপাইন বা অন্য দেশের কর্মীরা ইংরেজিতে যতটা দক্ষ, বাংলাদেশিরা তা নন। তাই কর্মীদের পাঠানোর আগে ভাষাগত দক্ষতার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। ইংরেজি এবং যে দেশে যাবে সে দেশের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।

জনশক্তি রফতানিকারকরা জানান, দরকষাকষিতে বাংলাদেশ শক্ত অবস্থান নিতে না পারায় কর্মীরা বেশি বেতন পাচ্ছেন না। মাসিক ২০০ ডলার বেতনে সৌদি আরব যাচ্ছেন বাংলাদেশের নারী কর্মীরা। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হয়। অথচ ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলংকা, নেপাল এত কম বেতনের কর্মী পাঠাতে রাজি হয়নি। মালয়েশিয়ায় মাসিক ৮০০ রিঙ্গিত বেতনে কর্মী পাঠাতে রাজি হয়েছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ রেমিট্যান্স আয় করেছে ১৫ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার বা ১ লাখ ১৯ হাজার কোটি টাকা। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ৭৬ লাখ বাংলাদেশি কর্মী বিদেশে কর্মরত আছেন। তাদের বার্ষিক মাথাপিছু রেমিট্যান্সের পরিমাণ ২ হাজার ১৩ ডলার। অর্থাৎ বাংলাদেশি কর্মীরা বছরে জনপ্রতি গড়ে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৩৫৫ টাকা দেশে পাঠান।

শীর্ষ রেমিট্যান্স আহরণকারী দেশগুলোর মাথাপিছু আয়ে পাকিস্তান, ভারত, মিসর, ফিলিপাইন, নাইজেরিয়ার চেয়েও পিছিয়ে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ভারতের মাথাপিছু রেমিট্যান্স আয় ৫ হাজার ১৯৪ ডলার বা ৪ লাখ ৮ হাজার টাকা। বাংলাদেশি কর্মীদের প্রায় তিনগুণ আয় করেন ভারতীয় কর্মীরা। ভারতের ১ কোটি ৩৯ লাখ প্রবাসী কর্মী ২০১৫ সালে ৭২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। গত ছয় বছরের মতো রেমিট্যান্স আয়ে শীর্ষস্থানে রয়েছে ভারত।

২০০৯ সালে পাকিস্তানের রেমিট্যান্স আয় ছিল ৮ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার। ওই বছর বাংলাদেশ আয় করে ছিল ১০ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার। ২০১৫ সালে ৬২ লাখ প্রবাসী পাকিস্তানি কর্মী দেশে পাঠিয়েছেন ২০ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার বেশি আয় করছে দেশটি। পাকিস্তানি প্রবাসী কর্মীদের মাথাপিছু রেমিট্যান্সের পরিমাণ সদ্য সমাপ্ত বছরে ছিল ৩ হাজার ২৪১ ডলার।

বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে গেছে মিসরও। ২০০৯ সালে উত্তর আফ্রিকার এ দেশটির রেমিট্যান্স আয় ছিল ৭ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। গত ছয় বছরে প্রায় তিন গুণ হয়েছে মিসরের রেমিট্যান্স আয়। ২০১৫ সালে ২০ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছেন মিসরের ৩৪ লাখ প্রবাসী কর্মী। মিসরের কর্মীদের মাথাপিছু রেমিট্যান্সের পরিমাণ ৬ হাজার ডলার। রেমিট্যান্স আয়ে তৃতীয় স্থানে থাকা ফিলিপাইনের কর্মীদের মাথাপিছু রেমিট্যান্সের পরিমাণ ৪ হাজার ৯৫ ডলার। ৬০ লাখ ফিলিপিনো প্রবাসী গত বছর দেশে পাঠিয়েছেন ২৯ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার।

সরকারি সংস্থা জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে বিদেশ যাওয়া কর্মীদের মাত্র ৩২ দশমিক ৬৮ ভাগ ছিল দক্ষ। ১৫ ভাগ ছিল আধাদক্ষ। ৪৯ দশমিক ৬১ ভাগই স্বল্প দক্ষ।

বিদেশগামী কর্মীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধিতে সরকারি পর্যায় থেকে বিভিন্ন উদ্যোগের কথা বলা হলেও পরিসংখ্যান বলছে ভিন্ন কথা। গত ৩৮ বছরে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া কর্মীর ৫০ দশমিক ২২ ভাগই স্বল্প দক্ষ। দক্ষ কর্মী রফতানি হয়েছে ৩১ ভাগ। ২০১৩ সালে ভারতের মোট রফতানির ৫৬ ভাগই দক্ষ। পাকিস্তান ও নেপাল দক্ষ কর্মী রফতানি করেছে ৪৩ ও ৩৮ ভাগ।

অভিবাসন বিষয়ক গবেষণা সংস্থা রামরুর পরিচালক অধ্যাপক ড. সি আর আবরার সমকালকে বলেন, দক্ষতার অভাবে বাংলাদেশি কর্মীরা বেশি আয় করতে পারছেন না। কারিগরি জ্ঞান না থাকায় ভালো চাকরি পাচ্ছেন না। ফলে মজদুরের কাজ করতে হচ্ছে তাদের। মাঝারি মানের পদগুলোতে অন্য দেশের কর্মীরা নিয়োগ পাচ্ছেন। এ কাজে আয় সবচেয়ে কম।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বিএমইটির পাঁচটি মেরিন টেকনিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটসহ ৭১টি টেকনিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটউট রয়েছে। তাতে ৪৭টি ট্রেডে কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। জেলা পর্যায়ে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি) এবং উপজেলা পর্যায়েও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। নূরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করা হয়েছে। ৪০ উপজেলায় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন প্রক্রিয়াধীন।(রাজীব আহাম্মদ, সমকাল)