সুফরা আল জাজিরা হোটেলের লবি ও লাউঞ্জ লোকে লোকারণ্য। বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষের ভাষায় সৃষ্টি হয়েছে বিচিত্র শব্দতরঙ্গ। পবিত্র মসজিদুল হারামে ওমরাহ পালনের জন্য স্রোতের মতো পূর্ণ্যার্থীদের আসা-যাওয়া চলছে। দিনে-রাতের বিরামহীন কাজের চাপে দিশেহারা বাংলাদেশি প্রবাসী কর্মচারী পেয়ার আহমদ বিড়বিড় করে বললেন, ‘প্রবাসীদের দুঃখ কেউ বুঝে না’!
‘মৌসুম বেহতেরিন’ বলে আলখাল্লা জড়ানো এক আরব হোটেলের সামনে আরবিভাষি এক উরদরিয়ান (জর্ডান) নাগরিককে আবহাওয়ার বিবরণ জানাচ্ছেন। এবার আবহাওয়া অতীব চমৎকার। তাই ওমরাহ হাজির আগমন হচ্ছে অধিক হারে। প্রায়-হজের মতো ভিড় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে সুপ্রাচীন এই আধ্যাত্মিক নগরে। সকল হোটেলই ভিড়াক্রান্ত।
গত অনেক বছর এমন নাতিশীতোষ্ণমণ্ডলীয় জলবায়ূ ঊষর মরু দিয়ে প্রবাহিত হয় নি। জাজায়ের (আলজেরিয়া) থেকে আসা বেন আবদুল্লাহ আটলান্টিক পাড়ের আবহাওয়ার তুলনা করছেন আনাতোলিয়ার (তুরস্ক) সুলেমান পাশার সঙ্গে। মনোযোগ দিয়ে আন্দালুসের (স্পেন) হাকাম আর শামিয়ার (সিরিয়া) তারিফ শুনছেন। কয়েক জন কুর্দিস্থানি নাগরিকেরও দেখা পাওয়া গেল। সুদূর চীনের উরঘুই-কাশগড় অঞ্চলের তুর্কিদের দেখেই চেনা গেলো। এদেরই মাঝে ক্লান্তিহীন পেয়ার আহমদ ও অন্যান্য বাংলাদেশি শ্রমিকরা নানা তৎপরতায় ব্যস্ত।
দেখা যাচ্ছে, মানুষের ঢল একা বা সদলবলে হয়ত মাত্র এসেছে। কেউ কয়দিনের স্বল্প অবস্থান শেষে আরেক পবিত্র নগর মদিনা কিংবা স্বদেশের পথে। কেউবা ঘুরে ঘুরে পছন্দসই হোটেল খুঁজছেন। সবাইকে সন্তুষ্ট করছেন কর্মীরা, যাদের সিংহভাগই বাংলাদেশি।
‘আমরা ইচ্ছা হলেই দেশে যেতে আসতে পারি না। টাকা জমিয়ে দুই বছরে অল্প সময়ের জন্য দেশে যেতে পারি। ছুটিও পাওয়া যায় না সব সময়’, বললেন পেয়ার আহমদ।
নোয়াখালীর ছেলে পেয়ার কলেজে পড়েছেন। পড়া শেষ করা আর হয় নি। ভাগ্যের টানে চলে এসেছেন বিদেশের কঠিন ও পরিশ্রমী জীবনে।
সামনের ক্যাফেটেরিয়ায় কাজ করেন কুমিল্লা ও ঢাকা এলাকার কয়েকজন। ‘কাজে ফাঁকি দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। দম ফেলার সময় পাই না আমরা।’ এক ফাঁকে জানালেন।
পবিত্র মক্কায় ঘড়ির কাঁটা মিনিট সেকেন্ড ধরে দিন-রাত্রের ভেতর দিয়ে চললেও কাজে বিরাম নেই কারোওই। এখানে বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে চব্বিশ ঘণ্টা মানুষ আসা-যাওয়া করেন। প্রার্থনায় সদা জাগ্রত পবিত্র মক্কা নগরে প্রবাসী শ্রমশক্তিকেও তাই জেগে থাকতে হয় অধিকাংশ সময়।
কাজ শেষে গাদাগাদি করে থাকতে হয় তাদের। নিজেদেরই রান্না করে খাবারের ব্যবস্থা করতে হয়। দেশের পরিবার-পরিজনের জন্য টাকা পাঠাতে উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে হয় তাদের। খরচ বাঁচাতে প্রায়-সবাই একা থাকেন স্ত্রী, পুত্র, কন্যাকে দেশে রেখে।
‘দেশে পাঠানো কষ্টের টাকা যখন নষ্ট হয়, তখন বুক ফেটে যায়। ছেলেমেয়ে মানুষ না হলে বা আমাদের টাকা সঠিকভাবে কাজে লাগানো না হলে সহ্য করতে পারি না, জানালেন টাঙ্গাইলের হুমায়ূন কবির। তিনি কাজ করেন একটি ‘বাকালা’ বা স্টেশনারি স্টোরে।
‘অনেক সময়ই আমরা দেশে টাকা পাঠিয়ে লোক মারফত জায়গা-জমি কিনতে চেষ্টা করি। অনেক ক্ষেত্রেই সে টাকা মার যায়’, তিনি বলেন, ‘প্রবাসী পরিবারের স্ত্রী-সন্তানরাও নানা দুর্ভেগের শিকার হয়। দেশে বসবাসকারী প্রবাসী পরিবারের কাছ থেকে অনেকেই নানা রকম সুযোগ হাতিয়ে নেয়। কাজের প্রচণ্ড চাপ ও কষ্ট আর দেশের নানা টেনশন নিয়েই কাটে আমাদের প্রবাস জীবন।’
কাজের ভেতর দিয়ে সময় কেটে গেলেও একাকী-নিঃসঙ্গতায় দুর্বিহ লাগে প্রবাস জীবন। সে জীবনেও যখন আঘাত, প্রতারণা, শত্রুতা এসে হানা দেয়, তখন প্রবাসীদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে, বুক ফেটে যায় বেদনায়। পেয়ার আহমদের কথাটিকেই তখন চরম সত্য বলে মনে হয়, ‘প্রবাসীদের দুঃখ কেউ বুঝে না।’
সৌজন্যে: বাংলানিউজ







































