Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

‘পারলে অন্য নারীদের সৌদি যাওয়া ঠেকান’

bd-womanবুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে দেশ ছেড়ে সৌদি আরব গিয়েছিলেন গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে। ফেরত এসেছেন পলিথিন ভরা কয়েকটি ছেঁড়া কাপড় নিয়ে। নির্যাতনের কোন কথা রেখে কোন কথা বলবেন তা ভাবতেই খেই হারিয়ে ফেলছিলেন বারবার। ‘ছবি, ভিডিও কইরা কী করবেন? পারলে অন্য নারীদের সৌদি যাওয়া ঠেকান। সৌদিতে আটকা পড়ছে যে নারীরা তাদের দেশে আননের ব্যবস্থা করেন।’ ক্ষোভ এবং অভিমান নিয়ে এই প্রতিবেদককে কথাগুলো বললেন সৌদি আরবের রিয়াদের ইমিগ্রেশন ক্যাম্প বা সফর জেল থেকে দেশে ফেরা এক নারী। রোববার দিবাগত রাত ১০টার দিকে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কথা হয় এই নারীর সঙ্গে।

নির্যাতনের শিকার ওই নারীসহ ফেরত এসেছেন ৩০ জন নারী। এদের সবার সকল ক্ষোভ গিয়ে পড়ছিল সরকার ও দালালদের ওপর। এই নারীরা ফিরছেন, গণমাধ্যমের কাছে আগে থেকে এ খবর ছিল। ফলে বিমানবন্দরের ভেতর থেকে ক্লান্ত পায়ে বের হয়েই এই নারীরা একাধিক গণমাধ্যমের ক্যামেরার মুখোমুখি হন। নিজের মুখ ঢাকতে এই নারীরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কেননা তাঁরা নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরেছেন এ খবর এলাকার লোকজন দেখে ফেললে লজ্জায় মুখ দেখানোর উপায় থাকবে না। এই নারীদের বেশির ভাগই দেশে ফিরেছেন সে তথ্য তাঁর পরিবারের স্বজনদেরও জানানোর সুযোগ পাননি। খালি হাতে ফেরত আসার কারণে বেশির ভাগের হাতে মুঠোফোনও নেই। গণমাধ্যমকর্মীদের কেউ কেউ কোনো কোনো নারীর বাড়ির মুঠোফোনে ফোন করে তাঁদের দেশে ফেরার খবর জানাতে সহায়তা করেন। অনেকেই জানেন না রাতের বেলা তাঁরা কোথায় যাবেন।

chardike-ad

নির্যাতনের শিকার হওয়া সৌদি আরব ফেরত এই নারীদের সহায়তা করতে বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির তথ্য কর্মকর্তা আল-আমিন। তিনি বলেন, যে নারীদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই তাঁদের ব্র্যাকের একটি সেন্টারে সাময়িক আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। আর যাঁদের যাওয়ার জন্য হাতে টাকা নেই সেই নারীদের আর্থিকভাবে সহায়তা করা হচ্ছে। অসুস্থ হয়ে কেউ ফিরলে তাঁদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কয়েক দিন বেশি সময় আশ্রয় লাগলে অভিবাসন নিয়ে কর্মরত ওকাবের আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা হচ্ছে।

ব্র্যাকের এই কর্মকর্তা জানালেন, তাঁকে কিছুদিন পরপরই ব্র্যাকের পক্ষ থেকে বিমানবন্দরে উপস্থিত হতে হচ্ছে ফেরত আসা নারীদের সহায়তা করার জন্য।
ব্র্যাকের পক্ষ থেকে ১২০ জনকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন করা হয়, এর মধ্যে এ নিয়ে মোট ৯০ জন নারীকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে বলে উল্লেখ করে আল আমিন জানালেন, সরকারের বিভিন্ন সংস্থার তথ্য এবং ব্র্যাকের বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মে থেকে ৩ জুন পর্যন্ত সৌদি আরবের রিয়াদ থেকে প্রায় তিন শ নারী ফেরত এলেন। এদের মধ্যে কেউ মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় ফিরেছেন, আবার কেউ বা ফেরত এসেছেন অন্তঃসত্ত্বা হয়ে। এই নারীদের অনেককে তাঁর পরিবারও আর ফিরিয়ে নিতে চাচ্ছে না। সরকারকে এখনই কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে হবে, এই নারীদের পাশে দাঁড়াতে হবে। তা না হলে এই নারীরা আবার নির্যাতনের শিকার হতে পারেন।

রোববার রাতে বিমানবন্দরে দেখা যায়, এয়ার এরাবিয়ার একটি উড়োজাহাজে করে দেশে আসা অন্য যাত্রীরা ট্রলি করে বিভিন্ন জিনিস নিয়ে বের হচ্ছেন, আর বিমানবন্দরে অপেক্ষমাণ স্বজনেরা তাঁদের দেখেই জড়িয়ে ধরছেন। অপেক্ষমাণ গাড়িতে করে তাঁরা বাড়ি ফিরছেন। তবে সৌদি থেকে ফেরত আসা নারীদের জন্য বিমানবন্দরে কেউ অপেক্ষায় ছিলেন না। একজনের হাতে ধরা একটি ট্রলিতেই ২৯ জনের মালামাল জায়গা হয়ে গিয়েছিল। কয়েকজনের হাতে ছিল পলিথিন বা ছোট কোনো ব্যাগ।

এই নারীদের একজন জানালেন, তিনি মাত্র চার মাস আগে সৌদি আরব গিয়েছিলেন। নির্যাতনে টিকতে না পেরে বাড়ি (যে বাড়িতে কাজ করতেন) থেকে পালিয়ে বাংলাদেশের দূতাবাসে আশ্রয় নেন।

খাবার না দেওয়া, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পারলে ২০ ঘণ্টাই কাজ করানো, বেতন চাইলে মারধর করা, বাথরুমে আটকে রাখা, বাড়িতে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে না দেওয়াসহ অসংখ্য নির্যাতনের কথা বলছিলেন একেকজন। যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তা কেউ সরাসরি স্বীকার করেননি। তবে কেউ কেউ বলেন, সে চেষ্টাও করেছে মালিক। তাই নিজের জীবন ও ইজ্জত বাঁচানোর জন্যই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি থেকে পালান। নিজেদের অভিজ্ঞতায় জানান, সফর জেলে থাকা আরও প্রায় ৫৯ নারীর কেউ কেউ যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। মারধর করে কারও কারও হাত পাও ভেঙে দেওয়া হয়েছে।

একজন জানালেন, তাঁকে তাঁর মালিক আরেক মালিকের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। কিন্তু চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে তা নবায়ন না করে খালি হাতে দেশে পাঠিয়ে দেন।

নয় মাস কাজ করার অভিজ্ঞতায় এক নারী বলেন, তিনি যে বাড়িতে কাজ করতে যান সেখানকার মানুষ খুব খারাপ ছিল। তলপেটে লাথি দিত। সারাক্ষণ খারাপ আচরণ করত। রাতে ঘুমাতে দিত না। দিনে রাতে দুই ঘণ্টা বিশ্রাম নিলে তাও নিতে হতো ভয়ে ভয়ে।

ফেরত আসা নারীদের অনেকে জানালেন, দেশে যদি ভিক্ষা করেও খেতে হয় খাবেন, তারপরও সৌদিতে আর কাজের জন্য যাবেন না। কেননা সেখানে মানসম্মান নিয়ে থাকার কোনো উপায় নেই। সরকার সব জানার পরেও নারীদের কেন সৌদি আরবে কাজের জন্য পাঠাচ্ছে সে প্রশ্নও তোলেন কেউ কেউ।

সৌজন্যে- প্রথম আলো