একসাথে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের পাশাপাশি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোটগতভাবে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেছে যুক্তফ্রন্ট ও জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়া। অপরদিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ৫ দফা দাবি ও ৯টি লক্ষ্য ঘোষণা অনুষ্ঠানে ঐক্যপ্রক্রিয়ার সভাপতি বিশিষ্ট আইনজীবি ড. কামাল হোসেন বলেছেন, বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের শুরু আজ (শনিবার)।
তিনি বলেন, জনগণ যেন তার মালিকানা ফিরে পায় সেব্যাপাওে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করতে হবে।জনগণ সে আন্দোলনে আছে তা এখন স্পষ্ট। তাই জনগণের বিজয় নিশ্চিত।
শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে যুক্তফ্রন্ট ও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেয়া হয। দুই জোটের পক্ষ এ ঘোষণা পড়ে শোনান নাগরিক ঐক্যের আহবায়ক যুক্তফ্রন্ট নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না। এসময় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফর উল্ল্যাহসহ গনফোরাম নেতাদের মধ্যে অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, অ্যাডভোকেট জগলুল হায়দার আফ্রিক, আওম শফিক উল্লাহ, মোশতাক আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, জেএসডি নেতাদের মধ্যে আবদুল শালেক রতন, তানিয়া রব প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে জাতীয় প্রেসক্লাবে এ ঘোষণা পাঠ করার আগে দুই জোটের পক্ষ থেকে সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দৌজা এবং বিশিষ্ট আইনজীীব এবং গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বিকাল তিনটায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যাওয়ার কথা ছিল। সেখানে তারা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই জাতীয় প্রেসক্লাবে ওই ঘোষণা দেয়া কথা ছির। । তবে সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দৌজা অনুষ্ঠানে আসার আগে অসুস্থ হয়ে পড়ায় জাতীয় প্রেসক্লাবে আসতে পারেননি।
পরে বিকাল চারটায় ড. কামাল হোসেন , আ স ম আব্দুর রব, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদের নেতৃত্বে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে একটি মিছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার অভিমুখে রওনা দেয়া হয়। কিন্তু জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনের সড়কে কয়েক গজ হেটে একটি প্রাইভেট কারের ওপরে দাড়িয়ে জেএসডি সভাপতি আ স ম আব্দুর রব জানান, ঢাবি কর্তৃপক্ষ তাদের শহীদ মিনারে যেতে দেযার অনুমতি দেয়নি।
এ ব্যাপারে রব আরো বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনুমতি না দেয়ায় তারা আবার জাতীয় প্রেসক্লাবে ফিরে আসেন। রব এ ব্যাপারে তার ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিচার জাতি করবে। এবং আগামী বছর ফেব্রুয়ারির আগেই যে বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিদায় নেন সেজন্য দোয়া করেন তিনি।
তিনি বলেন, জুলুমের অবসান হবেই। তার বক্তব্যের পরই নাগরিক ঐক্যের আহবায়ক যুক্তফ্রন্ট নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না পাচ দফা ও নয়টি লক্ষ্য পড়ে শোনান।
ঘোষণা পরপরই বিশিষ্ট আইনজীবি ড. কামাল হোসেন তার বক্তব্যে বলেন, এই দেশের মালিক জনগণ। দেশের মালিকদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারলে দেশ রক্ষা পাবে, গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত ও কালো টাকার প্রভাবমুক্ত হবে। রাষ্ট্র-সমাজ আগ্রাসন থেকে মুক্ত হবে। জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধিরা দেশের মালিকদের ভোটে নির্বাচিত হবে।
তিনি বলেন, কার্যকর গণতন্ত্র, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। নির্বাচনে ভেজাল হলে দেশের মালিক আর জনগণ থাকে না। এ ছাড়া আগামি তিন বছর পর স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি হবে উল্লেখ করে ড. কামাল বলেন, আমরা এ তিন বছরের মধ্যে দেশে কার্যকর গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও দেশের মালিক যে জনগণ তা প্রতিষ্ঠা করবো। মানুষের স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করবো। ব্যক্তির বাক স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনবো।
বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে পাঁচ দফায় বলা হয়েছে, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ (লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড) নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নির্বাচনি তফসিল ঘোষণার আগে বর্তমান সংসদ ভেঙে দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন করতে হবে। নির্বাচনকালীন সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না।
দ্বিতীয় দফায় রযেছে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাকস্বাধীনতা, ব্যক্তি, সংবাদপত্র, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সব রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা নিশচিত করতে হবে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে। তৃতীয়ত দফা রয়েছে কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী ছাত্র-ছাত্রীসহ সব রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারসহ গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি দিতে হবে।
এখন থেকে নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনও রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা যাবে না। চতুর্থ দফায় বলা হয়েছে, নির্বাচনের একমাস আগে থেকে নির্বাচনের পর ১০ দিন পর্যন্ত মোট ৪০ দিন প্রতিটি নির্বাচনি এলাকায় ম্যাজিস্ট্রেট ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে।
একইসঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়োজিত ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত করতে হবে। পঞ্চম দফায় উল্লেখ করা হয়েছে, নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের চিন্তা ও পরিকল্পনা বাদ দিতে হবে, ‘গণ প্রতিনিধিত্ব আদেশ-১৯৭২’এর যুগোপযোগী সংশোধনের মাধ্যমে গণমুখী করতে হবে। পাশাপাশি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে।
অপরদিকে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে নয়টি লক্ষ্য ঘোষণা করা হয়েছে।
এগুলি হচ্ছে, এক.দেশে স্বেচ্ছাচারী শাসন ব্যবস্থা থেকে পরিত্রাণ এবং একব্যক্তি কেন্দ্রিক নির্বাহী ক্ষমতা অবসানের লক্ষ্যে সংসদে, সরকারে, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনয়নসহ প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ, ন্যায়পাল নিয়োগ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কার্যকর করা। সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ কমিশন গঠন করা।
দুই. দুর্নীতি দমন কমিশনকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার নিশ্চিত করা হবে। দুর্নীতিমুক্ত, দক্ষ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন গড়ে তুলে সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে দুর্নীতিকে কঠোর হাতে দমন এবং ইতোপূর্বে দুর্নীতির দায়ে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা হবে।
তিন. দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির পরিবেশ সৃষ্টি, বেকারত্বের অবসান ও শিক্ষিত যুবসমাজের সৃজনশীলতাসহ রাষ্ট্রিয় পর্যায়ে নিয়োগদানের ক্ষেত্রে মেধাকে একমাত্র যোগত্যা হিসেবে বিবেচনা করা।
চার. কৃষক-শ্রমিক ও দরিদ্র জনগণের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সরকারি অর্থায়নে সুনিশ্চিত করা। পাঁচ. জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও স্থানীয় সরকারসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ দুর্নীতি ও দলীয়করণের কালো থাবা থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে এসব প্রতিষ্ঠানের সার্বিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন ও কাঠামোগত সংস্কার সাধন করা।
ছয়. রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, জনগণের আর্থিক স্বচ্ছলতা ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ রাষ্ট্রের সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের শৃঙ্খলা নিশ্চিত, জাতীয় সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার, সুষম বণ্টন ও জনকল্যাণমুখী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা।
সাত. জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্যমত গঠন এবং প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা ও নেতিবাচক রাজনীতির বিপরীতে ইতিবাচক সৃজনশীল এবং কার্যকর ভারসাম্যের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা।
আট. ‘সকল দেশের সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুত্ব কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়’- এই নীতির আলোকে জনস্বার্থ ও জাতীয় নিরাপত্তাকে সমুন্নত রেখে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা এবং প্রতিবেশী দেশসমূহের সঙ্গে পারস্পরিক সৎ প্রতিবেশিশুলভ বন্ধুত্ব ও সমতার ভিত্তিতে ব্যবসা বাণিজ্য, যোগাযোগ ও বিনিয়োগ ইত্যাদির ক্ষেত্রে আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার কার্যকর উদ্যোগ ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
নয়. বিশ্বের সকল নিপিড়ীত মানুষের ন্যায়সঙ্গত অধিকার ও সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তাদের দেশে ফেরত ও পুনর্বাসনের কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার। দেশের সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সুরক্ষার লক্ষ্যে প্রতিরক্ষা বাহিনীকে আধুনিক প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি ও সমর-সম্ভারে সুসজ্জিত, সুসংগঠিত ও যুগোপযোগী করা।