Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

প্রবাসী দুই বাবার ত্যাগের গল্প

মালদ্বীপে যে রিসোর্টটায় উঠেছিলাম আমরা,তার অনেকগুলো রেস্টুরেন্ট এর একটার কুক কাম সুপারভাইজার বাংলাদেশের মিজান ভাই। রেস্টুরেন্ট এ লাঞ্চ করতে গেলে উনি নিজে থেকে এসে পরিচিত হলেন! বললেন,বাঙ্গালী কাওকে দেখলে খুব ভাল লাগে তাই একপ্রকার যেচেই কথা বলেন।

chardike-ad

বুফে লাঞ্চ ছিল,মেন্যু পছন্দের কোন ব্যাপার ছিল না!!তবু আমার ছেলেদের মেন্যু উলটাতে দেখে উনি বললেন- আঙ্কেল কোন কিছু পছন্দ হলে বলেন, আমি বানিয়ে দিব। আমি হাও মাও করে উঠতেই উনি আমার মনের কথা বুঝতে পারলেন এবং ইশারা দিলেন- আপা,টাকা লাগবে না,আমি খাওয়াব আঙ্কেলদের।

এর নাম হচ্ছে স্বদেশ/স্বজাতি প্রীতি!!বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশী শত্রু দেখলেও মনে হয় গিয়ে জড়িয়ে ধরি। যাই হোক,ঘটনা সেটা না,ঘটনা অন্য!!প্রতিবেলা মিজান ভাই এর সাথে দেখা হয় আর আমরা আরেকটু বেশী পরিচিত হই!!

গল্প করে জানলাম উনি দেশ ছেড়েছেন পঁচিশ বছর আগে,তার বিয়েরও আগে!!নানা রকম কাজ করতে করতে শেষ পর্যন্ত রেস্টুরেন্টের কাজে থিতু হন!!ওই এক রিসোর্টেই আছেন তের চৌদ্দ বছর!!

যারা মালদ্বীপ গেছেন তারা জানেন ওরকম জনবিচ্ছিন্ন রিসোর্টে দিনের পর দিন,মাসের পর মাস,বছরের পর বছর থাকা কি প্যারা!!সিম্পলি পাগল হয়ে যাওয়ার কথা যে কোন মানুষের!!

জিজ্ঞেস করলাম – দেশে যান কয় বছর পর পর!!
বললেন- আপা,আমার ছোট মেয়ে ফাইভে পড়ে!! তাকে এখন পর্যন্ত দুইবার দেখসি!! জন্মের দেড় বছর পরে একবার আর তার আট বছর বয়সে একবার!!পাছ ছয় বছর পর পর যাই!!

– আর বড় জন কি করে?
– জ্বি আপনাদের দোয়ায় আমার বড় ছেলে জাপান যাচ্ছে গ্র্যাজুয়েশন করতে!!

জিজ্ঞেস করলাম ভাবির সাথেও তো তাহলে জীবনে পাঁচ ছয় বারের বেশী দেখা হয় নাই!!

উনি লজ্জা পেয়ে উত্তর দিলেন- জ্বি ওরকমই হবে

উনার কথা শুনে আমার কান্না চাপতে চাপতে গলা ব্যথা হয়ে গেল!!

বললাম- এই জীবন ভালো লাগে?এই অথই পানির মধ্যে দিনের পর দিন,পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করে না?

বললেন- আপা,এখন অভ্যাস হয়ে গেছে!! আগে কষ্ট হত খুব,ইচ্ছা করত চলে যাই দেশে!!কিন্তু বউ বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকায়ে থেকে গেলাম!!

কি অদ্ভুত তাইনা? বউ বাচ্চার মুখের দিকে তাকিয়ে তাদের মুখটাও না দেখে সারাটা জীবন যৌবন কাটিয়ে দিলেন!!

আমি একজন কুক মিজান ভাইয়ের আড়ালে থাকা একজন পিতার স্যাক্রিফাইসের গল্প মাথায় করে রিসোর্ট থেকে ফিরলাম!!

এলাম হুলহুমালের আরেক হোটেল এ!! হোটেল এর রুম বয় এর নাম প্রদীপ!!রুম বয় না বলে রুম ম্যান বলা ভাল,কারণ প্রদীপ বাবু একজন পুরদস্তুর পুরুষ মানুষ!!

রুম ম্যান প্রদীপ বাবুও আমাদের পেয়ে খুব খুশী !!মালদ্বীপ এমন কোন ভিনগ্রহ না,সেখানে প্রচুর বাঙ্গালিও যায় কিন্তু শ্রমিকশ্রেণীর মানুষেরা কেন জানি আমাদের সাথে খুব আপন আপন ব্যবহার করে!!

প্রদীপ সাহেবের সাথে খুব ভাব হল আমাদের!!গল্প করে জানা গেল উনি বেশীদিন না মাত্র দুই বছর হল মালদ্বীপ গেছেন!!আগামী পাঁচ বছরে দেশে আসতে পারবেন কিনা জানেন না!!

প্রদীপ বাবু একদিন আমাদের রুম ক্লিন করতে এসে বললেন – ম্যাডাম,একটা অনুরোধ ছিল!!

* – বলেন
* – আমি দেশে একটা ছোট্ট জিনিস পাঠাব আমার বাচ্চার জন্য!!আপনারা যদি একটু নিয়ে যেতেন!!স্যারের অফিস এর ঠিকানা টা আমাকে দিলে আমি লোক পাঠাব,সে অফিস থেকে নিয়ে নিবে!!

বললাম – আচ্ছা দিয়ে দিয়েন

যেদিন চলে আসব প্রদীপ বাবু ছোট্ট একটা প্যাকেট দিলেন র্যাপ করা!!

আমার স্বামী সিকিউরিটির কারণে র্যাপিং টা খুলে দেখাতে বললেন!!

খুলে দেখা গেল তাতে একটা রেইন কোট!!প্রদীপ বাবু গ্রামের স্কুলে পড়া তার পাঁচ বছর বয়সী পুত্রের জন্য একটা রেইন কোট পাঠাচ্ছেন!!পুত্র ঝড় জল গায়ে মেখে স্কুলে যায়,নিজে থাকলে হয়ত ছাতা হাতে কোলে করে পৌঁছে দিতেন,যেহেতু নাই তাই প্রটেকশন পাঠাচ্ছেন!!

ঘন ঘন চোখে পানি আসা খুব খারাপ কিন্তু আবার আমার চোখে পানি চলে এল!!

মানুষের সাথে মিশে যাওয়ার এই এক ঝামেলা!!মানুষের জীবনের এত ক্রাইসিস!!এই মালটিকালারড ক্রাইসিস দেখে “আমার জলেই টলমল করে আঁখি তোমার চোখের অশ্রু কোথায় রাখি”অবস্থা হয়!!

আমি দুই পিতার পাহার সমান ত্যাগ এর সাক্ষী হয়ে দেশে ফিরে এলাম!!

আমার এক ভাসুর জেদ্দা থাকেন ত্রিশ বছরের বেশী সময় ধরে!!ঢাকা ইউনিভারসিটি থেকে মাস্টার্স পাশ করেই উনি জেদ্দা চলে যান!!ওখানেই কর্মজীবনের শুরু!!

আমি বিয়ের পরে উনার গল্প শুনেছি,কয়েকবার দেখেছিও!!

মিরপুরে উনার পাঁচতলা বাড়ী, বড় ছেলে মায়ামি ইউনিভারসিটিতে পড়ে,মেয়েও পড়ে ঢাকার বিখ্যাত একটা প্রাইভেট ইউনিভারসিটিতে!!

ভাবী অসাধারণ কর্মঠ,রূপবতী গুণবতী একজন মানুষ,উনার বাড়ী এত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন যে মনে হয় পা দুইটা হাতে নিয়ে হাটি!!এরকম পরিষ্কার বাসায় হাটাও একটা ক্রাইম!!

কিন্তু ট্র্যাজেডি হল,ভাইজান কোনদিন এই পরিষ্কার বাড়ীতে থাকতে পারেন নি,গুণবতী স্ত্রীর হাতের রান্না খেতে পারেন নি,রূপবতী স্ত্রীর সানিধ্য পাননি!!উনি দুই দুই তিন বছরে একবার এসেছেন,অতিথির মত থেকে চলে গেছেন!!

ভাইজানের জেদ্দার বাসায় বেড়াতে গেলাম একবার!!না গেলেই বোধয় ভাল হত!!ষাঠ বছর বয়সী ভাইজানের সেই নিঃসঙ্গ,একাকীত্বের জীবন না দেখলেই ভাল হত!!

আমরা যাব বলে ভাইজান অনেক কিছু রান্না করেছিলেন!!

খাবার সময় বললেন -আমি তো বেশী কিছু রাঁধতে পারিনা!! তোমার ভাবী থাকলে কত কিছু রান্না করে খাওয়াত!!এ্যাজ ইফ ভাবী উনার সাথেই থাকেন,কয়েকদিনের জন্য বাপের বাড়ী বেড়াতে গেছেন!!পরে মনে হল,হয়ত উনার কল্পনায় ভাবী উনার সাথেই থাকেন,নইলে বেচে আছেন কিভাবে? এতগুলো বছর ? একা?

শান এ নজুল শেষ!!এবার মূল বক্তব্য!!

সারা দুনিয়ার মানুষ,মা বলতে অজ্ঞান হয়ে যায়!!একজন মায়ের ত্যাগকে যেভাবে গ্লোরিফাই করা হয় তার সহস্রভাগের একভাগও পিতার ত্যাগকে করা হয় না!!

অথচ একজন পিতার ত্যাগ একজন মায়ের থেকে কোন অংশে কম না!! বরং কোথাও কোথাও অনেক বেশী!!পিতা তার নিজের অস্তিত্ব বিলিয়ে দেন নিজের অস্ত্বিত রক্ষা করতে!!এবং এই কাজটা এতটাই নীরবে করেন যে আমরা ভুলেই যাই যে উনি আছেন এবং উনার ছায়াতেই আমরা বেচে আছি!!

পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রী তাপমাত্রায় হেরা পর্বতের উপত্যকায় তপ্ত মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে এক কাশ্মীরি লোক আরবি ক্যালেন্ডার বিক্রি করছিল ৫ রিয়েল দাম এর!!

ট্যুরিস্টদের দিয়ে তাকিয়ে বলছিল- এক লিজিয়ে না বেহেন জি,মেরে বিবি বাচ্চা ভুখা হ্যাঁয়!!

আমার ইচ্ছা করছিল বলি,ভাই এই পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রী তাপমাত্রায় তপ্ত বালুর উপরে দাড়ায়ে ক্যালেন্ডার না বেঁচে সংসার ছেড়ে পালানো তো আরও সহজ ছিল!!পালান নাই কেন?

উত্তর যদিও আমি জানি!!পালান নাই কারণ উনি একজন পিতা!!

“পিতা”সবচেয়ে আনসাং,সবচেয়ে কম প্রেইজড,সবচেয়ে আননোটিসড,কিন্তু সবচেয়ে ভ্যালুয়েবল মানুষ!!

যতক্ষণ পর্যন্ত উনি থাকেন ততক্ষণ পর্যন্ত,উনি যে আছেন, এটাও বুঝতে দেন না

লেখক- রাখী নাহিদ এর ওয়াল থেকে