পুলিশের ৬০৭ কোটির সম্পদ তছনছ

chardike-ad

 

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নানা স্থাপনায় হামলা চালিয়েছিল দুর্বৃত্তরা। হামলায় পুলিশের অনেকে নিহত বা আহত হয়েছে; জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে যানবাহন ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। থানাসহ পুলিশের স্থাপনা থেকে ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে গুলি চালালে অনেকেই মারা যান; পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন অনেকে। উন্নত চিকিৎসার জন্য কেউ কেউ দেশের বাইরে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

 

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়। আইজিপিসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের সরিয়ে নতুনদের বসানো হয়। তারা আন্দোলনে পুলিশের স্থাপনাসহ বিভিন্ন স্থানে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা তদন্ত করেন।

পুলিশ সদর দপ্তর নিশ্চিত হয়েছে, দুর্বৃত্তদের হামলায় পুুলিশের অবকাঠামো তছনছ হয়েছে। ৬০৭ কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে। তদন্তসংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। যানবাহন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় নতুন করে ২৭৫ কোটি টাকার গাড়ি কেনার পরিকল্পনা নিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুর্বৃত্তদের হামলায় ২৭১ কোটি ৬৭ লাখ ৩৭ হাজার টাকার যানবাহন, ৪ কোটি ৩২ লাখ ২৮ হাজার টাকার মোটরসাইকেল, ২১৩ কোটি ৫৩ লাখ টাকার পুলিশি স্থাপনা, ১২ কোটি ৭৮ লাখ ৯০ হাজার টাকার টেলিযোগাযোগ সরঞ্জাম, ২৬ কোটি ৬৭ লাখ ৪০ হাজার ৬৫০ টাকার পোশাকসামগ্রী ও ৭৮ কোটি ৬৭ লাখ ৪০ হাজার ৬৫০ টাকার অন্যান্য সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে ৬০৭ কোটি ১৩ লাখ ১৮ হাজার ৯৭৫ টাকার সম্পদ নষ্ট হয়েছে।

ডিএমপিসহ দেশের কয়েকটি থানার সাবেক ওসি দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, ‘ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় আমরা ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশে দায়িত্ব পালন করেছি। ঊর্ধ্বতনদের বারবার আমরা বলেছি, সাধারণ শিক্ষার্থী ও লোকজন আন্দোলন করছে। তাদের ওপর গুলি চালানো ঠিক হবে না। আমাদের অনুরোধ ঊর্ধ্বতনরা রাখেননি। আমরা আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার শেল ছুড়লে উত্তেজিত হাজার হাজার মানুষ বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল মারতে থাকে। বাইরে থেকে গুলিও আসতে থাকে। একপর্যায়ে থানায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। আত্মরক্ষার্থে পুলিশ গুলি করতে থাকে। কিন্তু টিকতে না পেরে তারা পোশাক খুলে পালিয়ে যায়। যারা পালাতে পারেনি, তারা নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। আমরা চাই, এসব ঘটনায় থানায় মামলা হোক। সঠিক তদন্ত হওয়া উচিত। সিসিটিভি ফুটেজ জোগাড় করে যারা হামলায় জড়িত তাদের চিহ্নিত করা গেলে পুলিশের মনোবল বাড়বে।’

পুলিশসূত্র জানায়, সারা দেশে ৫৮টি থানায় আগুন দেওয়া হয়েছে; ভাঙচুর করা হয়েছে ৫৬টি। ২৬টি ফাঁড়িতে আগুন দিয়েছে ও ২৪টি ভাঙচুর করেছে দুর্বৃত্তরা। দুটি তদন্ত কেন্দ্রে আগুন দেওয়া হয়েছে ও ১২টি ভাঙচুর করা হয়েছে; ১০৬টি পুলিশ বক্সে আগুন ও ৩০টিতে ভাঙচুর, ২৯টি অফিসে আগুন ও ২৮টিতে ভাঙচুর; ১৫টি পুলিশ লাইনসে ভাঙচুর, ৩টি অন্যান্য স্থাপনায় আগুন ও ৭৩টিতে ভাঙচুর করা হয়েছে। ২২৪টি স্থাপনায় আগুন দেওয়া হয়েছে ও ২৩৬টি স্থাপনা ভাঙচুর করা হয়েছে। ৩০০টি যানবাহনে ভস্মীভূত করা হয়েছে; ভাঙচুর করা হয়েছে ৫৪৮টি। তার মধ্যে রয়েছে ১৩টি জিপ, ১৭৩টি ডাবল কেবিন পিকআপ, ৫৬টি সিঙ্গেল কেবিন পিকআপ, ১২টি প্যাট্রলকার, ১২টি মাইক্রোবাস, ২টি অ্যাম্বুলেন্স, ৩ ও ৫ টনের ১২টি ট্রাক, ২টি বাস, ২টি প্রিজন ভ্যান, ৮টি রেকার, ৪টি এপিসি, ১টি জলকামান ও ২টি ক্রাইম সিন ম্যানেজমেন্ট ভ্যান। ২৭১ কোটি ৬৭ লাখ ৩৭ হাজার টাকার যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া ১৫৬টি মোটরসাইকেল আগুন ছাই হয়ে গেছে; ভাঙচুর করা হয়েছে ৭৩টি মোটরসাইকেল। এতে ক্ষতি হয়েছে ৪ কোটি ৩২ লাখ ২৮ হাজার টাকা। এসব ঘটনায় কিছু সাধারণ ডায়েরি ও মামলা হয়েছে। পুলিশ আলাদাভাবে বিষয়গুলোর তদন্ত করছে।

সদ্য বিদায়ী ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মাইনুল হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পুলিশ হত্যা, থানায় অগ্নিসংযোগ ও অস্ত্র লুটের ঘটনায় মামলা হবে। যেসব থানা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেগুলো প্রায় সংস্কার করা হয়েছে। যানবাহনের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও আরও উন্নতির চেষ্টা চলছে। ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে অনেক। পুলিশের টহল ও চেকপোস্ট কার্যক্রমও কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছে।’

সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে জানায়, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের স্থাপনায় দফায় দফায় হামলা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। ১৬ জুলাইয়ের পর আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের গুলিতে ১ হাজার ৪২৩ শিক্ষার্থী ও নিরীহ লোক মারা গেছে। আহত হয়েছে ২২ হাজার শিক্ষার্থী ও সাধারণ লোক। এখনো অনেকে সংকটাপন্ন। হামলার সময় থানা, ট্রাফিক অফিস ও বক্সে হামলা চালিয়ে এসি, কম্পিউটার, চেয়ার-টেবিল লুটপাট করা হয়েছে। বেশিরভাগ স্থাপনায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়; নষ্ট করা হয় গুরুত্বপূর্ণ আলামত। পুলিশের আগ্নেয়াস্ত্র লুটও করা হয়েছে। দুর্বৃত্তদের হামলায় সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানার ১৩ পুলিশ সদস্য মারা গেছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ৫০টি থানা আছে। তার মধ্যে ২১টি থানাসহ পুলিশের ২১৬টি স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। পুড়ে গেছে ১৩টি থানা। পুলিশের বেশ কিছু টহল গাড়িও পোড়ানো হয়েছে। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যাত্রাবাড়ী ও উত্তরা পূর্ব থানা। টাঙ্গাইলের গোড়াই হাইওয়ে থানা, বগুড়ার সদর, দুপচাঁচিয়া ও শেরপুর থানা এবং নারুলী পুলিশ ফাঁড়ি, জয়পুরহাট সদর থানা, কুমিল্লার ইলিয়টগঞ্জ হাইওয়ে থানা, রংপুরের গঙ্গাচড়া, মিঠাপুকুর, পীরগাছা, পীরগঞ্জ ও বদরগঞ্জ; ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর ও আশুগঞ্জ থানা, সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর, উল্লাপাড়া ও শাহজাদপুর থানা, হবিগঞ্জের মাধবপুর ফাঁড়ি, ময়মনসিংহ রেঞ্জ অফিস, নারায়ণগঞ্জ, বগুড়া, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ পুলিশ সুপারের কার্যালয়, দিনাজপুর সদর থানাসহ অনেক স্থাপনায় হামলা হয়েছে ও আগুন দেওয়া হয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পুুলিশের যানবাহন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় নতুন গাড়ি কেনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে পুলিশ সদর দপ্তর একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছে। ৪৩১টি যানবাহন কিনতে ২৭৪ কোটি ৯৯ লাখ টাকার বাজেট ধরা হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তর ৭২২টি গাড়ি কেনার জন্য ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব দিয়েছে। মন্ত্রণালয় ৪৩১টি যানবাহন কিনতে ২৭৪ কোটি ৯৯ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে।

প্রস্তাবে বলা হয়েছে, যানবাহনের সংকট কাটাতে পুলিশের জন্য যানবাহন জরুরি হয়ে পড়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও কাজের গতি বাড়াতে ৩৮টি জিপ, ২৫০টি ডাবল কেবিন পিকআপ, ৫৬টি সিঙ্গেল কেবিন পিকআপ, ১২টি প্যাট্রল কার ও মাইক্রোবাস, ২টি অ্যাম্বুলেন্স, ২০টি ট্রাক, ২টি বাস, ১২টি প্রিজন ভ্যান, ২৮৫টি মোটরসাইকেল, ৮টি রেকার, ৪টি এপিসি, ১টি জলকামানসহ মোট ৭২২টি যানবাহন কেনা দরকার। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, যানবাহনের সংখ্যা আরও কমাতে হবে। পরে সিদ্ধান্ত হয়, ৩০টি জিপ, ২০০টি ডাবল কেবিন পিকআপ, ৮টি মাইক্রোবাস, ১৬টি ট্রাক, ৪টি বাস, ১৫২টি মোটরসাইকেল, ৮টি রেকার, ৪টি এপিসি, ১টি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ডগভ্যানসহ ৪৩১টি যানবাহন কেনা হবে। ছয় মাসের মধ্যে যানবাহনগুলো কেনার কথা রয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের নানা অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পুলিশের স্থাপনায় হামলার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে। নতুন যানবাহন কেনার চেষ্টা চলছে। পুলিশের মনোবল বাড়াতে যা যা করা দরকার আমরা তা করব।’