সড়কটি ২০২২ সালে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। যতটুকু ক্ষতি হয়েছে, তা অল্প টাকায় মেরামত করা সম্ভব। কিন্তু সেই সড়কে ৬৮০ কোটি টাকা ব্যয়ের আয়োজন করেছিল সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর। অন্তর্বর্তী সরকারের সড়ক মন্ত্রণালয়ের তদন্তে বিষয়টি ধরা পড়েছে।
সড়কটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জ জেলায় পড়েছে। নাম সরাইল-নাসিরনগর-লাখাই-হবিগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়ক। দৈর্ঘ্য ৩০ কিলোমিটার। সড়ক মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, কৌশলে বিপুল ব্যয়ের চেষ্টা ধরা পড়ার পর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কারণ দর্শানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে গতকাল রোববার সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান ‘বুড়ো উপদেষ্টারা কী করে’ শিরোনামে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। তিনি লেখেন, ‘হবিগঞ্জ এলাকায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত একটি সড়ক মেরামত ও প্রশস্তকরণ প্রকল্পে কয়েকটি প্যাকেজে প্রায় ৩০ কিলোমিটার রাস্তার ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৮০ কোটি টাকা।
সব পরীক্ষা–নিরীক্ষা শেষে সরকারি ক্রয় কমিটির অনুমোদনের জন্য পাঠাই। পাশাপাশি সড়ক বিভাগের একজন কর্মকর্তাকে সরেজমিনে দেখতে পাঠাই। সরেজমিনে দেখা যায়, মাত্র ৭৫০ মিটার রাস্তা পুনর্নির্মাণ করা প্রয়োজন!’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘হাওর অঞ্চলের রাস্তাটিতে যানবাহন চলাচল সীমিত, শিল্পকারখানা নেই। প্রকল্পের কোনো যৌক্তিকতা নাই। টেন্ডার হয়ে যাওয়া ক্রয় প্রস্তাবগুলি ফিরিয়ে নিই।…ভালো রাস্তা মেরামত করে প্রকৌশলী, ঠিকাদার, রাজনীতিবিদদের লুটপাটের দারুণ বন্দোবস্ত।’
যেভাবে ধরা পড়ল ‘লুটপাটের বন্দোবস্ত’
সরাইল-নাসিরনগর-লাখাই-হবিগঞ্জ আঞ্চলিক সড়কটি দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল থেকে নাসিরনগর, হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলা হয়ে হবিগঞ্জ শহরে যাওয়া যায়। স্থানীয় ব্যক্তিরা বলছেন, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে বড় ধরনের যানজট তৈরি হলে মাঝেমধ্যে এই সড়ক দিয়ে ঢাকা-সিলেট পথের বাস চলাচল করে। আর হবিগঞ্জ থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রাম পথে ২০-২৫টি বাস নিয়মিত চলাচল করে। তবে মূল যানবাহন অটোরিকশা, ইজিবাইক ও মোটরসাইকেল।
সওজ সূত্র জানায়, সড়কটি বর্তমানে সাড়ে ৫ মিটার বা প্রায় ১৮ ফুট চওড়া। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে সড়কটি সম্প্রসারণ ও মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ‘২০২২ সালের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ সড়ক বিভাগাধীন বিভিন্ন সড়ক, সেতু ও কালভার্টসমূহের জরুরি পুনর্বাসন ও পুনর্নির্মাণ’ প্রকল্পের আওতায় ঢোকানো হয় সরাইল-নাসিরনগর-লাখাই-হবিগঞ্জ ৩০ কিলোমিটার সড়ক।
সড়কটি মেরামত ও সম্প্রসারণ কাজ চারটি ভাগে (প্যাকেজ) ভাগ করে বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর মধ্যে সাড়ে ৯ কিলোমিটারের সম্প্রসারণ ও মেরামতের জন্য প্রায় ১৪৩ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়। ঠিকাদার হিসেবে মোস্তফা জামান ট্রেডার্স, মোস্তফা কামাল ও ইডেন প্রাইস (যৌথ) নির্বাচন করে সওজের হবিগঞ্জ কার্যালয়। তারা ১৪২ কোটি ৮০ লাখ টাকা দর প্রস্তাব করে সর্বনিম্ন দরদাতা হয়।
ঠিকাদার নিয়োগের প্রক্রিয়া গত মাসে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছিল। সন্দেহ হলে মন্ত্রণালয় থেকে একজন কর্মকর্তাকে সরেজমিন পরিদর্শনে পাঠানো হয়। মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তদন্ত কর্মকর্তা সরেজমিনে দেখতে পান, সড়কের সংশ্লিষ্ট অংশের মাত্র ৭৫০ মিটার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত, যা ১০-১৫ কোটি টাকাতেই মেরামত করা সম্ভব। কিন্তু বেশি টাকা ব্যয় করতে সড়কটি দ্বিগুণ চওড়া করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। অথচ তার যৌক্তিকতা নেই।
যেভাবে প্রকল্প বড় হয়
সওজ সূত্র জানায়, ৩০ কিলোমিটার সড়কের বন্যা ক্ষতিগ্রস্ত অংশ মেরামতে বড়জোর ৮০ থেকে ১০০ কোটি টাকা লাগতে পারে। কিন্তু ব্যয় বাড়ানোর জন্য সড়কটি ১০ দশমিক ৩ মিটারে উন্নীত করার জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। পুরো ব্যয় সরকারের রাজস্ব খাত থেকে নির্বাহ করার কথা। এই কাজের জন্য হবিগঞ্জ সড়ক বিভাগের আওতায় চারটি দরপত্র আহ্বান করা হয়।
সওজ সূত্র জানায়, দরপত্রগুলো গত বছরের মে মাসের দিকে আহ্বান করা হয়েছিল। দরপত্রপ্রক্রিয়া চলাকালে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এর মধ্যে দরপত্রের মেয়াদ বাড়িয়ে ঠিকাদার নিয়োগপ্রক্রিয়া শুরু হয় গত মাসে।
ঠিকাদার নিয়োগপ্রক্রিয়া পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সব কটি ভাগের কাজেই তিন-চারটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ঘুরেফিরে অংশ নিয়েছে। একেক ঠিকাদার একটি কাজ পেয়েছে। এমনও দেখা গেছে যে এক ঠিকাদার এক প্যাকেজে সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে। একই ঠিকাদার অন্য প্যাকেজে সর্বোচ্চ দরদাতা।
সওজের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে বলেন, বিগত সরকারের আমলে দরপত্র আহ্বানের আগেই কোন ঠিকাদার কোন কাজটি পাবে, তা নির্ধারিত হয়ে যেত। ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিবিদ, সওজ ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে কাজ ভাগ করা হতো।
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর খরচ কমানোতে গুরুত্ব দিয়েছে। পাশাপাশি যে কাজের ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তা কতটা যৌক্তিক তা দেখতে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বেছে বেছে বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হচ্ছে। এতেই অনিয়ম বেরিয়ে আসছে।
অনিয়মের উদাহরণ দিতে গিয়ে মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বলছে, সওজের অধীন নারায়ণগঞ্জের ভুলতা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর হয়ে নবীনগর পর্যন্ত আঞ্চলিক সড়ক প্রশস্ত করার আরেকটি প্রকল্প চলমান আছে। সরাইল-নাসিরনগর-লাখাই-হবিগঞ্জ সড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়া অংশের সম্প্রসারণ কাজ ওই প্রকল্পের একটি প্যাকেজে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। অথচ দুটি কাজের একটি থেকে অন্যটির দূরত্ব শত কিলোমিটারের কাছাকাছি। এই কাজে ওয়াহিদ কনস্ট্রাকশন নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ৩৪৩ কোটি টাকা দর প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু সড়ক মন্ত্রণালয় এটি আবার দরপত্র আহ্বানের নির্দেশ দিয়েছে।
সড়ক মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে বলেন, পছন্দের ঠিকাদারেরা যাতে বেশি ব্যয়ের কাজ পান, সে জন্য প্রকল্প বড় করার প্রবণতা সওজে রয়েছে।
খবর: প্র.আ