সোমবার । ডিসেম্বর ১৫, ২০২৫
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ৪ জুলাই ২০২৫, ১১:১৪ পূর্বাহ্ন
শেয়ার

দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রতিদিন গড়ে প্রাণ দিচ্ছেন ৪০ জন


korea-frustrationদক্ষিণ কোরিয়ায় আত্মহত্যার হার উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। ‘কোরিয়া ফাউন্ডেশন ফর সুইসাইড’-এর সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে দেশটিতে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ১৪ হাজার ৪৩৯টি, অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৪০ জন মানুষ নিজেই নিজের জীবনের ইতি টেনেছেন। এই হার অনুযায়ী, প্রতি ১ লাখ কোরিয়ান নাগরিকের মধ্যে ২৮.৩ জন আত্মহত্যা করেছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মহত্যার এ প্রবণতা কোরীয় সমাজে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা অতিরিক্ত প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, মানসিক স্বাস্থ্যের অবহেলা এবং কঠোর কর্মসংস্কৃতির ফল। বিশেষ করে শিক্ষাব্যবস্থায় অল্প বয়সেই শিশুদের কঠিন চাপের মুখে ফেলা হচ্ছে। সামাজিক ব্যাধির রূপ নেওয়া এই সংকট এখন জাতীয় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মাত্র চার বছর বয়সেই শিশুদের রচনা লেখার মতো জটিল বিষয় আয়ত্ত করতে বাধ্য করা হয়। স্কুল শেষে তাদের পাঠানো হয় বিভিন্ন প্রাইভেট টিউশনে, যেখানে রাত পর্যন্ত চলে পড়াশোনা। অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার তাদের আয়ের ৩০ শতাংশ ব্যয় করে সন্তানের অতিরিক্ত শিক্ষার পেছনে। ফলে মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং হতাশা শিশু বয়সেই প্রকট হয়ে ওঠে।

২০২৫ সালের শুরুতে একটি আত্মহত্যা প্রতিরোধ সংস্থা জানায়, কোরিয়ায় আত্মহত্যার সংখ্যা গত ১৩ বছরে সর্বোচ্চে পৌঁছেছে। তরুণদের মধ্যে মানসিক ভারসাম্যহীনতা বাড়ছে, বাড়ছে সামাজিক অনাস্থা।

এর সঙ্গে যোগ হয়েছে জনসংখ্যা সংকট। বিশ্বের মধ্যে সর্বনিম্ন জন্মহারের দেশ এখন দক্ষিণ কোরিয়া। ২০২৪ সালে দেশটির মোট প্রজনন হার কমে দাঁড়িয়েছে ০.৬৮, যা ২০২৩ সালের ০.৭২ এবং ২০২২ সালের ০.৮১ থেকেও কম। অথচ স্থিতিশীল জনসংখ্যা বজায় রাখতে প্রয়োজন ২.১। বিশেষজ্ঞদের মতে, এভাবে হার কমতে থাকলে ২১০০ সালের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার জনসংখ্যা এক-তৃতীয়াংশে নেমে আসতে পারে।

অন্যদিকে, বাহ্যিক সৌন্দর্যের প্রতি অতিরিক্ত গুরুত্ব এবং রূপবৈষম্যের সংস্কৃতিও তরুণ প্রজন্মের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। প্লাস্টিক সার্জারি কোরীয় সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে, যেখানে কলেজ শেষে সৌন্দর্য বাড়াতে ছেলেমেয়েরা অস্ত্রোপচার করান পরিবারের সহায়তায়। চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রেও সৌন্দর্যকে বিবেচনা করা হয়, যা আরও একধরনের মানসিক চাপ তৈরি করে।

কর্মঘণ্টা এবং জীবনযাত্রার ভারসাম্যহীনতা আরও একটি বড় কারণ। ২০২১ সালে দক্ষিণ কোরীয়রা বছরে গড়ে ১,৯১৫ ঘণ্টা কাজ করেছেন, যা উন্নত দেশগুলোর গড় সময়ের চেয়ে প্রায় ২০০ ঘণ্টা বেশি। এতে কর্মীদের ব্যক্তিগত জীবন, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

ন্যাশনাল হেলথ ইনশিওরেন্স সার্ভিসের এক গবেষণা বলছে, ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সীদের মধ্যেই দেখা যাচ্ছে বার্ধক্যজনিত রোগের আশঙ্কাজনক প্রবণতা—যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, গাউট এবং আর্থ্রাইটিস।

সব মিলিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া এখন এক জটিল সামাজিক-জনসংখ্যাগত সংকটের মুখে। আত্মহত্যা, জন্মহারে ধস ও অতিরিক্ত কর্মচাপ—এই ত্রিমাত্রিক চাপে দমবন্ধ হয়ে পড়ছে তরুণ প্রজন্ম।