
পৃথিবীর সব জায়গায় সূর্যের নিয়ম একরকম নয়। কোথাও সূর্য কয়েক সপ্তাহ ধরেই অস্ত যায় না, আবার কোথাও মাসের পর মাস সূর্য দেখা যায় না—শুধু অরোরার আলো ভেঙে দেয় অন্ধকারকে। আলো-অন্ধকারের এই অদ্ভুত পরিবর্তন মানুষের জীবনেও প্রভাব ফেলে। কোথাও মানুষ মধ্যরাতে খাবার খায়, কোথাও উৎসব চলে রাত জেগে, আবার শীতের দীর্ঘ রাত হয়ে ওঠে নিঃশব্দ ধ্যানের সময়। যদি কখনো জানতে চান কেমন লাগে দিন কিংবা রাত শেষ না হলে, তবে এই দেশগুলোতে ভ্রমণই হতে পারে আপনার অভিজ্ঞতার নতুন জানালা।

নরওয়ে
নরওয়ে মধ্যরাতের সূর্যের জন্য সবচেয়ে বিখ্যাত। আর্কটিক সার্কেলের ভেতরে ট্রম্সো, নর্ডক্যাপ, লোফোটেন দ্বীপপুঞ্জ কিংবা সভালবার্ডে গেলে সূর্য টানা কয়েক সপ্তাহ আকাশে ঝুলে থাকতে দেখবেন। সভালবার্ডে এপ্রিলের শেষ থেকে আগস্টের শেষ পর্যন্ত সূর্য একদম অস্ত যায় না, বরফ আর হিমবাহগুলো তখন অদ্ভুত আভায় ঝলমল করে। ট্রম্সো ও উত্তর উপকূলে মে-শেষ থেকে জুলাই-শেষ পর্যন্ত প্রায় ৭৬ দিন একটানা আলো থাকে—রাতবিরাতে পাহাড়ে হাঁটা, ফিয়র্ডে কায়াক চালানো বা মধ্যরাতে সূর্যের দিগন্তে নামা দেখা—সবকিছুই তখন সম্ভব। জুনের অয়নকালের সময় আলো সবচেয়ে উজ্জ্বল থাকে, তাই জুন ও জুলাইয়ের শুরু নরওয়ে ভ্রমণের সেরা সময়।

আইসল্যান্ড
আইসল্যান্ডে জুন মাসে সূর্য দিগন্তের নিচে নামে না, বিশেষ করে যদি যান গ্রিমসে দ্বীপে—যেটি আর্কটিক সার্কেলের ভেতরে দেশের একমাত্র অংশ। রাজধানী রেইকিয়াভিক আর দক্ষিণাঞ্চলে পুরোপুরি মধ্যরাতের সূর্য দেখা না গেলেও রাত গভীর পর্যন্ত আকাশ আলোয় ভরে থাকে। গ্রীষ্মকালীন অয়নকালে গেলে আসল অভিজ্ঞতা পাবেন—লাভার মাঠে হাঁটা, গরম পানির ঝরনায় গোসল করা, আর আলোকোজ্জ্বল আকাশের নিচে রাত জেগে কাটানো।

সুইডেন
সুইডিশ ল্যাপল্যান্ডে—কিরুনা, আবিস্কো, গেল্লিভারে—মে-শেষ থেকে জুলাই’র মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় ৫০ দিন ধরে সূর্য অস্ত যায় না। আবিস্কো বিশেষভাবে জনপ্রিয় কারণ এখানকার আকাশ পরিষ্কার থাকে এবং জাতীয় উদ্যানের পথগুলো রাত ২টায় দিনের আলোয় অন্য জগতের মতো দেখায়। এ সময় মানুষ ক্যাম্প করে, মাছ ধরে, আর গ্রীষ্মের বারবিকিউতে মেতে ওঠে। জুনের শুরু সবচেয়ে ভালো সময়—মশা কম থাকে, আর ভিড়ও কম।

ফিনল্যান্ড
ফিনিশ ল্যাপল্যান্ডে দিনের আলো যেন থেমে যায়। উটসিয়কি আর উত্তরাঞ্চলের গ্রামগুলোতে মে-মাঝামাঝি থেকে জুলাই-শেষ পর্যন্ত সূর্য টানা ৭০ দিনেরও বেশি অস্ত যায় না। রোভানিয়েমি—যেটি সান্তা ক্লজের “অফিশিয়াল শহর”—সেখানেও প্রায় এক মাস এই অবস্থা থাকে। এই সময়ে মানুষ মধ্যরাতে গলফ খেলে, ভোররাতে হ্রদে সাঁতার কাটে, আর টর্চ ছাড়াই পাহাড়ে হাঁটে। জুন মাস এখানে ভ্রমণের সেরা সময়, জুলাইয়ের শেষে অল্প অল্প করে রাত ফিরে আসে, আর তার সঙ্গেই দেখা মেলে নর্দার্ন লাইটস-এর।

যুক্তরাষ্ট্র (আলাস্কা)
আলাস্কার উত্তর প্রান্তে পৃথিবীর দীর্ঘতম দিনের আলো পাওয়া যায়। উটকিয়াগভিক (বারো) শহরে মে-মাঝামাঝি সূর্য ওঠে আর আগস্টের শুরু পর্যন্ত আর অস্ত যায় না—মানে টানা ৮৪ দিন আলো। গ্রীষ্মকালে টুন্ড্রায় ফুল ফোটে, আর সাগরে ভেসে বেড়ায় বোহেড তিমি। ফেয়ারব্যাঙ্কস আর ডেনালি অঞ্চলে সূর্য পুরোপুরি না থাকলেও অয়নকালে প্রায় ২২ ঘণ্টা আলো থাকে—যা একটার পর একটা হাইকিং বা মধ্যরাতের মাছ ধরার জন্য যথেষ্ট।

গ্রিনল্যান্ড
গ্রিনল্যান্ডে গ্রীষ্মে সূর্যের আলো যেন ফুরোয় না। ক্যানাক ও উত্তর প্রান্তে এপ্রিলের শেষ থেকে আগস্টের শেষ পর্যন্ত সূর্য অস্ত যায় না। ইলুলিসাতে—যেখানে ইউনেসকো তালিকাভুক্ত ফিয়র্ডে বরফখণ্ড ভেসে যায়—সেখানে জুন-জুলাইয়ে প্রায় ছয় সপ্তাহ টানা মধ্যরাতের সূর্য থাকে। বরফখণ্ডগুলো তখন সোনালি আভায় ঝলমল করে, যা ফটোগ্রাফারদের জন্য এক স্বপ্ন। জুলাই নৌভ্রমণ আর তিমি দেখার সেরা সময়।

কানাডা
কানাডার আর্কটিক অঞ্চল—ইউকন, নর্থওয়েস্ট টেরিটরিজ আর নুনাভুতেও টানা আলোর গ্রীষ্ম থাকে। নুনাভুতের উত্তরাঞ্চলে সূর্য প্রায় দুই মাস অস্ত যায় না, বিশেষ করে অয়নকালের সময়। আরও দক্ষিণে হোয়াইটহর্স বা ইয়েলোনাইফে পুরোপুরি মধ্যরাতের সূর্য দেখা না গেলেও রাত গভীর পর্যন্ত গোধূলি থেকে যায়। জুন মাস সবচেয়ে ভালো সময়—ক্যানো ভ্রমণ, বন্যপ্রাণী দেখা আর গাড়ি নিয়ে দীর্ঘ ভ্রমণের জন্য।

রাশিয়া
রাশিয়ার উত্তর-পশ্চিমের মুরমানস্ক শহরে মে-র শেষ থেকে জুলাইয়ের শেষ পর্যন্ত প্রায় দুই মাস সূর্য অস্ত যায় না। সূর্য আকাশে ঘুরতে থাকে কিন্তু দিগন্তের নিচে নামে না, ফলে পুরো কোলা উপদ্বীপ আলোয় ভেসে থাকে। এই সময়ে টুন্ড্রার পথে হাঁটা, হোয়াইট সাগরে নৌভ্রমণ, আর স্থানীয় সামি সংস্কৃতি উপভোগ করার সুযোগ মেলে। জুন মাস ভ্রমণের সবচেয়ে উজ্জ্বল আর স্মরণীয় সময়।





































