Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

দালালের দৌরাত্ম্যে পাসপোর্ট দুর্ভোগ

passport-office
যাত্রাবাড়ীর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস

মোহাম্মদ নয়ন বারবার ফোন দিচ্ছিলেন আনসার কনস্টেবল আনোয়ারকে। আনোয়ার ফোন ধরেননি। অথচ তিনি নয়নকে বলেছিলেন, গত বৃহস্পতিবার তাঁর দুই ভাগনির পাসপোর্ট বুঝিয়ে দেবেন। রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর পাসপোর্ট অফিসে দুই ঘণ্টা অপেক্ষার পর নয়ন জানান, আনসারের আনোয়ার দুই ভাগনির পাসপোর্ট করিয়ে দেওয়ার জন্য ১৫ হাজার টাকা নেন। ১০ দিন আগে পাসপোর্ট দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু পাননি।

যাত্রাবাড়ীর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা নয়নের অভিযোগ অস্বীকার করেননি আনোয়ার। তাঁর দাবি, পাসপোর্ট করার জন্য এক লোক নয়নকে সাহায্য করতে বলায় তাঁকে সাহায্য করেন। পাসপোর্ট করার জন্য অনেক খরচ আছে। সেই খরচের জন্য টাকা নেন।

chardike-ad

আনোয়ারের মতো যাত্রাবাড়ীর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে এক শক্তিশালী দালাল চক্রের সিন্ডিকেট রয়েছে। দালালের খপ্পরে পড়া নয়নের মতো বেশ কয়েকজনের খোঁজ মিলেছে, যাঁদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করছে এই দালাল চক্র। গত বুধবার যাত্রাবাড়ীর পাসপোর্ট অফিস ঘুরে মিলেছে এসব তথ্য। সোমবার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এক প্রতিবেদনে বলেছে, পাসপোর্ট করতে গিয়ে সেবাগ্রহীতারা সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি ও হয়রানির শিকার হন পুলিশি ছাড়পত্রের (ভেরিফিকেশন) ক্ষেত্রে। পুলিশি তদন্তে সেবাগ্রহীতাদের ৭৬ দশমিক ২ শতাংশ অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার হয়েছেন এবং ৭০ দশমিক ৩ শতাংশ সেবাগ্রহীতাকে পুলিশকে ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ দিতে হয়েছে।

রায়েরবাগের মুজাহিদনগরের একটি ভাড়া বাসায় চলছে এই পাসপোর্ট অফিসের কার্যক্রম। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে আধা কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান। ছোট্ট গলির রাস্তা দিয়ে সেখানে যেতে হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পাসপোর্ট অফিসের একজন কর্মকর্তা বলেন, আবাসিক এলাকার মধ্যে অফিস হওয়ায় স্থানীয় কয়েকজন দালাল নিয়মিত অফিসে আসেন। লোকজনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পাসপোর্ট করিয়ে দেন। এঁদের কিছু বলতে গেলেও বিপদ।

কুমিল্লার সাইফুল ইসলাম ঢাকায় টিউশনি করে পড়াশোনা চালাচ্ছেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত একটি কলেজে ইংরেজি সাহিত্যের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র তিনি। এক মাসের মধ্যে পাসপোর্ট করিয়ে দেওয়ার কথা বলে জামান নামের পাসপোর্ট অফিসের এক দালাল তাঁর কাছ থেকে ৮ হাজার টাকা নেন। ১৫ দিন আগে তাঁর পাসপোর্ট দেওয়ার কথা ছিল। বৃহস্পতিবার আসেন পাসপোর্ট নিতে। দুই ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকায় পর অফিসের পাসপোর্ট বিতরণ শাখা থেকে তাঁকে বলা হয়, পাসপোর্ট এখনো তৈরি হয়নি।

dalal
আনসার সদস্যের পাশে এক দালাল

ক্ষুব্ধ সাইফুল বলেন, জীবনে আগে কোনো দিন পাসপোর্ট অফিসে আসেননি। দালাল জামান টাকা খেল, কিন্তু পাসপোর্ট দিচ্ছেন না। ভেরিফিকেশনের (ছাড়পত্র) জন্য ওয়ারী থানার এসআই হারুন অর রশীদ নিলেন ৫০০ টাকা। কুমিল্লায় গ্রামের বাড়ি থেকে আলমগীর নামের এক পুলিশ টাকা নিয়েছে ১ হাজার। সাইফুলের এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে ওয়ারী থানার এসআই হারুন অর রশীদ বলেন, কেউ খুশি হয়ে টাকা দিলে নেন। জোর করে কারও কাছ থেকে টাকা নেন না।

নয়ন ও সাইফুলের মতো পাসপোর্ট নিতে আরও ১০ ব্যক্তি অভিযোগ করেন, প্রত্যেককে পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। নিয়ম হলো, যে ব্যক্তি পাসপোর্টের জন্য আবেদন করবেন তাঁকে সশরীরে হাজির হয়ে পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে হবে। অথচ দেখা গেল এর উল্টো চিত্র। একেকজন দালাল চার থেকে পাঁচটি করে পাসপোর্ট সংগ্রহ করছেন। এসব পাসপোর্ট দিচ্ছেন অফিসের সুইপার অজয়। পাসপোর্ট করতে আসা কয়েকজন অভিযোগ করলেন, আনসার সদস্য আনোয়ার, হামিদসহ আরও চারজন নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন, যাঁরা পাসপোর্ট করিয়ে দেওয়ার নাম করে টাকা নিয়ে থাকেন।

সুইপারের পাসপোর্ট বিতরণ ও দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য প্রসঙ্গে জানতে চাইলে যাত্রাবাড়ীর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপসহকারী পরিচালক আবদুর রশীদ বলেন, দালালের দৌরাত্ম্য যে আছে, তা অস্বীকার করব না। আবাসিক এলাকায় অফিস হওয়ায় স্থানীয় লোকজনের নেতৃত্বে দালাল চক্র আছে। তাদের ঠেকাতে তৎপর থাকেন নিরাপত্তারক্ষীরা। আনসার সদস্যদের কেউ দালাল হিসেবে কাজ করছেন কি না, তা তিনি জানেন না।

যাত্রাবাড়ীর পাসপোর্ট অফিসের দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরা হলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পাসপোর্ট অফিসের দায়িত্বপালনকারী আনসার-পুলিশ, অফিসের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী ও দালাল সিন্ডিকেট সেবাগ্রহীতার কাছ থেকে ঘুষ আদায় করছে। ভেরিফিকেশনের জন্য টাকা আদায় করছে পুলিশ। এই দুর্নীতি ঠেকাতে হলে পাসপোর্ট অফিসের এসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে শনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন। এখন যাঁদের স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র রয়েছে তাঁদের পাসপোর্ট করার জন্য পুলিশের কোনো ভেরিফিকেশনের দরকার নেই। যাঁদের স্মার্টকার্ড নেই, তাঁদের জন্মসনদ নিয়ে পাসপোর্ট দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে দুর্নীতি অনেকাংশে কমে যাবে। প্রথম আলো