Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

প্রবাসীদের কিছু কষ্ট একান্ত নিজের!

shiponআমার আত্নীয়স্বজন, পরিচিতজন আর বন্ধুরা প্রায়ই অভিযোগ করে বলে, তুমি বিমানে চড়ে প্রবাসে গিয়ে বেঈমান হয়ে গেছো! কতদিন হয়ে গেল কল দেও না। নাকি অনেক টাকার মালিক হয়েছো! টাকা চাইব এই ভয়ে কল দেও না? ভয়ের কিছু নেই টাকা চাইব না।

প্রতিত্তরে তাদের কিছু বলি না, বলতেও পারি না। কারন তাদের বললেও তারা বুঝবে না। আমি জানি তাদের অভিযোগ সত্য তাই আমি নীরবে কথার তীরে বিদ্ধ হতে থাকি। পৃথিবীতে কথার তীরের মত বিষাক্ত বুঝি কিছুই নেই। নিজেকে নিয়ে এতই ব্যস্ত থাকি যে কারো সাথে কথা বলার সুযোগ হয় না। তাদেরকে কি করে বুঝাব আমার ব্যস্ততার কথা৷ একাকীত্বের কথা৷

chardike-ad

রাত্রীর শেষ প্রহরে কোমলতা নেমে আছে পৃথিবীর বুকে। তখন পৃথিবীটা খুব শান্ত ও সুন্দর লাগে৷ চোর, সাধু রাতজাগা মানুষগুলো শেষ প্রহরে ঘুমকে আলিঙ্গন করে নেয়৷ এই সময়টায় থেমে যায় মদের বারগুলোর উল্লাস ধ্বনি। মাতালরা যে যেখানে পারে গড়াগড়ি করে নেয়। রাত জেগে উদ্বুস্ত ময়লার স্তব থেকে খাবার অন্বেষণকারী কুকুরগুলোও ক্লান্তিতে শুয়ে পড়ে৷ প্রকৃতি ঘুমন্ত নগরীর ওপর বিছিয়ে দেয়, এক অনৈসর্গিক সৌন্দর্য্যের ওড়না৷ আর আমি তখন সেই কোমলতা, অনৈসর্গিক ওড়না ভেঙ্গে জেগে উঠি, ঘুমাতোর চোখে ছুটে চলি জীবিকার সন্ধানে।

কোম্পানির গাড়ি অফিসের গেটে পৌঁছলেও ঘুম আমাকে ছাড়ে না। তাই যেখানে সুযোগ পাই, সেখানেই ঘুমিয়ে নেই খানিকটা সময়। অনেকে তো রাস্তার পাশে গাছতলায়ও ঘুমিয়ে পড়ে। ডিউটি সাড়ে সাতটায় কিন্তু কোম্পানির গাড়ি ছয়টার আগেই অফিসে এনে পৌঁছে দেয়। তাই সাতটা দশ মিনিট পর্যন্ত ঘন্টা খানেক ঘুমিয়ে নেই৷

কাজ শুরু করার পূর্বে সুপারভাইজারের ব্রিফিং শেষ হলেই শুরু হয় সংগ্রাম। এই সংগ্রাম নিজে বেঁচে থাকা এবং পরিবারের সবার মুখে হাঁসি ফুটানোর সংগ্রাম।

দুপুরের খাবার সে’তো কতদিন হয়ে গেল প্লেটে খাইনি। কোন একসময় তো সুন্দর নকশা করা প্লেট ছাড়া খেতেই পারতাম না। আর এখন একধরনের কাগজের উপর (মাখান পেপার) খেয়ে নেই। কিন্তু আফসোস কাগজের উপর (মাখান পেপার) থেকে ডালটা চুমুক দিয়ে খেতে পারি না। অথচ কোন এক সময় খাবার শেষে চুমুক দিয়ে ডাল না খেলে আমার খাবার খেয়ে তৃপ্তিই হত না।

খাবার শেষে আমার ব্রিফিং আবার কাজ এভাবেই চলে বিকাল অবধি। বিকালে হালকা চা, কফি কিংবা একটা বিস্কুট খেয়ে ঝিরিয়ে নেই। কখনো বাবার সাথে কিংবা ভাইদের সাথে চলে কিছুটা আলাপচারিতা।

আমাদের ডিউটি চলাকালীন সময় সাধারণ কর্মীদের মোবাইল ফোন ব্যবহার করা নিষেধ। আমি মোবাইল বহন করতে পারলেও যত্রতত্র ব্যবহার করতে পারি না। কোম্পানির প্রয়োজন ছাড়া মোবাইল ব্যবহার করা দৃষ্টিকটু। তাই মোবাইলটা সযত্নে পকেটেই পড়ে থাকে।

দিনের কাজ সমাপ্তি আবারও গেটের বাহিরে কোম্পানির পরিবহনের এর জন্য অপেক্ষা। হর্ন দিয়ে গাড়ির আগমন, হুরাহুরি করে গাড়িতে উঠি। গাড়িতে বসে দম বন্ধ হবার উপক্রম সহকর্মী আর আমার গায়ের ঘাম শুকিয়ে বিদঘুটে এক গন্ধ বের হয়। এই গন্ধ শুকতে শুকতেই বাসায় ফিরি।

প্রথম প্রথম ঘামের গন্ধে বমি আসত, অস্বস্তি অনুভব করতাম। কিন্তু এখন অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। মানুষকে নাকি যেকোন জায়গায় অনেকদিন রাখলে সে জায়গার মায়া জন্মে যায়, তাই সে যেকোন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেয়। আচ্ছা নরকেও যদি অনেকদিন রাখা হয় একসময় কি আমি সেখানে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে যাব?? সে জায়গায় প্রতি মায়া জন্মে যাবে?

বাসায় ফিরে দিনের ব্যবহৃত কাপড় ধৌত করে গোসল করার পর রাত নয়টা বেজে যায়। আর তখন শুরু হয় রান্নার কাজ। রান্না শেষ করে খেতে খেতে রাত প্রায় এগারটা।

সারাদিন প্লান ছিল অনেকের সাথে কথা বলব কিন্তু খাবার পর বিছানায় গা এলিয়ে দিলেই ক্লান্তিতে চোখ দুটি বন্ধ হয়ে আসে। কারো সাথে কথা হয় না, কারো কাছে নিজের কষ্টগুলো শেয়ার করা হয় না।

এভাবেই চলছে দিন, মাস আর বছর। কিন্তু কাউকে এই ব্যস্ততার কথা বুঝাতে পারি না। সবাই মনে করে আমি সারাদিন অফিসে বসে থাকি। মাঝেমাঝে নিজেকে অন্যের কাছে ব্যাখা করে আর কি হবে! কিছু কিছু কষ্ট থাক না একান্ত নিজের৷

লেখক- ওমর ফারুকী শিপন, সিঙ্গাপুর প্রবাসী