মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত বাজেট ও করছাড়বিষয়ক বিলকে ‘ঘৃণ্য বিকৃতি’ উল্লেখ করে এর সমালোচনা করেছেন প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ইলন মাস্ক। সাবেক মিত্রের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্যেই এই মন্তব্য করলেন মাস্ক। খবর বিবিসির।
বিতর্কিত এই বাজেট বিলটি গত মাসে মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষে (হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস) পাস হয়েছে। বিলটিতে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলারের করছাড়, প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি এবং যুক্তরাষ্ট্রের ঋণের সীমা বাড়ানোর প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
‘যারা এই বিলে ভোট দিয়েছেন, তাদের লজ্জা হওয়া উচিত’, এমন মন্তব্য করেছেন মাস্ক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে। এই বিলকে ট্রাম্পের সম্ভাব্য দ্বিতীয় মেয়াদের ‘মূল পরিকল্পনা’ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
গত সপ্তাহে ১২৯ দিন দায়িত্ব পালন শেষে হঠাৎ করেই ট্রাম্প প্রশাসন থেকে বিদায় নেন মাস্ক। সরকারি দক্ষতা বৃদ্ধি সংক্রান্ত দপ্তর (ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সি) পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
সরকার ছাড়ার পর এই প্রথমবার ট্রাম্পের সঙ্গে প্রকাশ্যে মতবিরোধ জড়ালেন মাস্ক। এর আগে তিনি বিলটিকে ‘হতাশাজনক’ বলে মন্তব্য করেছিলেন।
মাস্কের ট্রাম্প প্রশাসনে দায়িত্ব পালনের মেয়াদ শেষ হয় ৩১ মে। যদিও ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘সে [ইলন মাস্ক] সবসময় আমাদের সঙ্গে থাকবে, সব পথে আমাদের সহায়তা করবে।’
বর্তমানে বিলটি যেভাবে তৈরি হয়েছে, ট্রাম্প যেটিকে ‘বড় সুন্দর বিল’ বলছেন, তা আগামী অর্থবছরে সরকারের আয়-ব্যয়ের ঘাটতি প্রায় ৬০০ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ৪৪৪ বিলিয়ন পাউন্ড) বাড়িয়ে দিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মঙ্গলবার একাধিক এক্স পোস্টে ইলন মাস্ক বলেন, ‘অত্যন্ত অপচয়পূর্ণ ও নিজ স্বার্থে ভরা’ এই বিল যুক্তরাষ্ট্রের বাজেট ঘাটতিকে বিশালভাবে বাড়িয়ে ২.৫ ট্রিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাবে এবং দেশের নাগরিকদের ওপর এক ধরনের ‘অসম্ভব ঋণের বোঝা’ চাপিয়ে দেবে।
যদিও এর আগে ট্রাম্পের এজেন্ডার বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া যেকোনো রিপাবলিকানের বিরুদ্ধে প্রচারের জন্য অর্থ সহায়তার প্রতিশ্রুতি আগে দিয়েছিলেন মাস্ক। এবার এক পোস্টে রাজনৈতিক হুঁশিয়ারিও দেন তিনি।
তিনি লিখেছিলেন, ‘আগামী বছরের নভেম্বরেই আমরা সব সেই রাজনীতিকদের বিদায় জানাব, যারা আমেরিকান জনগণকে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।’
মাস্কের মন্তব্য নিয়ে প্রথম পোস্টের কিছুক্ষণ পর সাংবাদিকরা জানতে চাইলে হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট আগে থেকেই জানেন, এই বিল নিয়ে ইলন মাস্কের অবস্থান কী।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই বিলটি এক কথায় বড়, সুন্দর একটি বিল। প্রেসিডেন্ট এতে অটল আছেন।’
এই আইনে ২০১৭ সালে ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে পাস হওয়া কর ছাড়ের মেয়াদ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি রয়েছে। সেই সঙ্গে প্রতিরক্ষা খাতে বড় অঙ্কের বরাদ্দ এবং অবৈধ অভিবাসীদের ব্যাপকভাবে বহিষ্কারের জন্য তহবিল নিশ্চিত করার কথাও বলা হয়েছে।
তবে সরকারের ব্যয় সীমা—যাকে ‘ঋণসীমা’ বলা হয়—তা ৪ ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার প্রস্তাবে খুশি নন আর্থিক সংযমে বিশ্বাসী রক্ষণশীলরা।
মাস্কের মন্তব্য রিপাবলিকান দলের ভেতরে আরও বড় মতভেদের ইঙ্গিত দেয়। বিলটি হাউসে পাস হওয়ার সময়ই দলের ভেতরে ভিন্ন মত দেখা গিয়েছিল। এখন সেটি সিনেটে উঠেছে, যেখানে রিপাবলিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা খুবই কম। সেখানে ইতোমধ্যেই বিভক্তির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
কেন্টাকির রিপাবলিকান সিনেটর র্যান্ড পল কয়েকদিন ধরে স্পষ্ট করে বলেছেন, যদি বিলটি ঋণসীমা বাড়ায়, তবে তিনি এতে সমর্থন দেবেন না।
তিনি সিবিএস নিউজকে বলেন, ‘এই বিল পাস হলে ঋণের দায় পুরোপুরি রিপাবলিকানদেরই নিতে হবে।’
ট্রাম্প র্যান্ড পলকে একাধিক সামাজিক মাধ্যম পোস্টে আক্রমণ করে বলেন, তিনি [পল] এই বিল সম্পর্কে ‘খুব সামান্যই বোঝেন’ এবং দাবি করেন, ‘কেন্টাকির মানুষ তাকে সহ্য করতে পারেন না।’
ট্রাম্প আরও লেখেন, ‘তার চিন্তাধারাগুলো আসলেই পাগলাটে।’
মাস্কের মন্তব্যকে ঘিরে রিপাবলিকান সিনেটররাও প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা জন থুন সাংবাদিকদের বলেন, ‘মতবিরোধ থাকলেও আমরা পূর্ণ গতিতে এগোচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘এই এজেন্ডা আমাদের প্রচারণার অন্যতম ভিত্তি ছিল, বিশেষ করে প্রেসিডেন্টের।’
হাউস স্পিকার মাইক জনসন, যিনি এই বিলটি পার্লামেন্টে পাস করিয়েছেন, সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার বন্ধু ইলন একদম ভুল করেছেন।’
তিনি বলেন, ‘এই বিলটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচনা। ইলন বিষয়টি বুঝতে পারেননি।’
জনসন জানান, বিলটি নিয়ে সোমবার তিনি মাস্কের সঙ্গে ২০ মিনিটের ফোনালাপ করেছেন। এতে বিদ্যুৎচালিত গাড়ির কর ছাড় ধীরে ধীরে তুলে নেওয়ার বিষয়টি টেসলার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
‘আমি দুঃখিত যে এরকম কিছু হবে,’ বলেন জনসন। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ফোনালাপের পরেও মাস্ক কেন প্রকাশ্যে সমালোচনা করলেন, তা তিনি বুঝতে পারছেন না। ‘আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত যে সে এমন ভুল করেছেন।’
অ্যাক্সিওসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাস্ক যে কয়েকটি বিষয়ে ক্ষুব্ধ তার একটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের বিমান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা। মাস্ক চাইছিলেন, এটি যেন তার স্টারলিংক স্যাটেলাইট ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হয়। কিন্তু প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা ও স্বার্থসংঘাতের শঙ্কায় এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হয়।
ডেমোক্রেটদের মধ্যে অনেকে, যদিও এর আগে মাস্ক ও তার সরকারি দক্ষতা বৃদ্ধি সংক্রান্ত দপ্তর (ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সি বা ডোজ)-এর কাজের সমালোচক ছিলেন, এখন তার বক্তব্যকে স্বাগত জানাচ্ছেন।
সিনেটের ডেমোক্রেট নেতা চাক শুমার বলেন, ‘ইলন মাস্ক পর্যন্ত বলেছেন বিলটি খারাপ—যিনি পুরো প্রক্রিয়ার একজন অংশ ছিলেন, ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ বলেও পরিচিত। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, বিলটি কতটা খারাপ।’
এই বিলটি ৪ জুলাইয়ের মধ্যে পাস করিয়ে আইনে পরিণত করার লক্ষ্য ঠিক করেছেন ট্রাম্প ও কংগ্রেসের রিপাবলিকানরা।
গত বছরের নভেম্বর নির্বাচনে ট্রাম্পকে সমর্থন দিয়ে মাস্ক ২৫০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি অনুদান দিয়েছিলেন।
সরকারি ব্যয় কমানো নিয়ে আপসহীন যেসব রিপাবলিকানকে খুশি রাখতে চান ট্রাম্প, তাদের জন্যও তিনি একটি বিকল্প প্রস্তাব পেশ করেছেন। এতে ৯.৪ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হ্রাসের পরিকল্পনা রয়েছে, যা মূলত মাস্কের ‘ডোজ’ টিমের বিশ্লেষণ থেকে নেওয়া।
এই প্রস্তাবে বিদেশি সাহায্য, ইউএসএআইডি, এবং এনপিআর ও পিবিএস-এর মতো সরকারি সম্প্রচারমাধ্যমগুলোর বাজেট ছাঁটাই করার কথা বলা হয়েছে।