
নদীর মাঝখানে একটা পলাশ গাছ কাটার চেষ্টা করছেন এক ব্যক্তি, আর তার ঠিক পেছনে টিনের শিট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কয়েকজন। যিনি গাছ কাটার চেষ্টা করছেন, তাকে লক্ষ্য করে ক্রমাগত পাথর-বৃষ্টি চলছে।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বেশ কয়েকবার পাথরের আঘাত লাগায় শেষমেষ গাছ কাটা ছেড়ে তিনিও প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে টিনের শিটের দিকে দৌড়াতে থাকেন। আর এই দৃশ্য দেখতে জড়ো হয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। চিৎকার করে, তালি বাজিয়ে উৎসাহ দিচ্ছেন তারা।
মধ্যপ্রদেশের পান্ধুর্ণ শহরের এই দৃশ্য আপনাকে হতবাক করতে বাধ্য। প্রতি বছর এখানে এই দৃশ্য দেখা যায়। জাম নদীর দুই পাড়ে জড়ো হওয়া মানুষের মধ্যে ‘হু … হা… মারো- এ ধরনের শব্দগুলো প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। এটাই এখানকার রেওয়াজ।
লোকে বলে এর সূত্রপাত কয়েক শত বছর আগের এক প্রেমের কাহিনীকে ঘিরে। ওই প্রেমের সম্পর্ক ঘিরেই দুই গ্রামের মধ্যে তৈরি হয় বিরোধ, যা গড়ায় পাথর ছোড়াছুড়ি ও লড়াই পর্যন্ত। এর সত্যতা অবশ্য প্রমাণ হয়নি। তবে পাথর-বৃষ্টির একটি রেওয়াজ এখনো জারি রয়েছে।
ফিরে আসা যাক, আগের দৃশ্যে, জাম নদীর তীরে।
এত কোলাহলের মধ্যে কোনদিকে চোখ রাখবেন আপনি? যারা পাথর ছুঁড়ছে তাদের দিকে না কি আকাশের দিকে, যেখান থেকে আপনার দিকেও যে কোনো সময়ে পাথর ধেয়ে আসতে পারে।
এই সব কিছুর মাঝেই অবশ্য কয়েকজন তরুণ মোবাইলে ভিডিও বানাচ্ছিলেন। তাদের সতর্ক করে দিতে একজন বয়স্ক ব্যক্তি কিছুটা রসিকতা করে বলে ওঠেন, “একটু সরে দাঁড়াও বাপু, পাথরের কিন্তু চোখ থাকে না।”
ধীরে ধীরে উল্লাসিত জনতার শোরগোল বাড়তে থাকে। শব্দের মাত্রাও বাড়তে থাকে। হঠাৎই জনতার ভিড় ভেদ করে ছুটে আসেন কয়েকজন, সঙ্গে পাথরের আঘাতে আহত এক ব্যক্তি।
দৃষ্টি আবার চলে যায়, জাম নদীর দিকে।
নদীর দুই দিকে দু’টো গ্রাম- পান্ধুর্ণ এবং সাবরগাঁও। নদীর মাঝখানে থাকা পলাশ গাছটা দুই গ্রামের মানুষের জন্যই জয়ের প্রতীক। সকাল ন’টা থেকে দুই গ্রামের মধ্যে এই পাথর ছোঁড়ার লড়াই শুরু হয়েছে।
প্রতি বছর দুই গ্রামের মধ্যে যে খেলার আয়োজন করা হয়, তার নাম ‘গোটমার মেলা’। নামে মেলা হলেও এটা আসলে একটা ভয়ঙ্কর খেলা যেখানে প্রতি বছর শত শত মানুষ আহত হন, পঙ্গু হয়ে পড়েন, এমনকি তাদের মৃত্যুও হয়।
এদিকে জাম নদীর দুই দিক থেকে চলা এই পাথরবৃষ্টিতে বিকেলের মধ্যেই এক হাজার মানুষ আহত হয়ে গেছেন।
পান্ধুর্ণ জেলার পুলিশ সুপার সুন্দর সিং কানেশ বিবিসিকে বলেন, “প্রতি বছর ৫০০ থেকে ৬০০ মানুষ আহত হয়। প্রশাসন এটা বন্ধ করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু স্থানীয় লোকেরা বিষয়টাকে পরম্পরা হিসেবে বিবেচনা করায় আমাদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।”
একটা বহুতল থেকে পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছিলেন প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। সেখান থেকে নদীর দিকে তাকালে মনে হবে আকাশজুড়ে পাথর রয়েছে।
পাথর ছোঁড়ার লড়াই
ভাদ্র মাসের অমাবস্যায় ‘পোলা উৎসব’ পালন করা হয়। হিন্দু ক্যালেন্ডার অনুযায়ী সাধারণত অগাস্ট বা সেপ্টেম্বর মাসে পড়ে এটা।
খরিফ ফসলের (বর্ষাকালে যে ফসল বপন করা হয়) দ্বিতীয় পর্যায়, অর্থাৎ আগাছা পরিষ্কারের কাজ শেষ হওয়ার পরে পালন করা হয় এই উৎসব।
এই উৎসব কৃষকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। পোলা উৎসবের দ্বিতীয় দিনে জাম নদীর মাঝখানে পতাকার মতো করে একটা পলাশ গাছ লাগানো হয়, তারপর দুই গ্রামের মানুষ পরস্পরের দিকে পাথর ছুঁড়তে থাকে। এটাই চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে।
তবে শুধু এই দুই গ্রামের মানুষই নয়, আশপাশের জেলা থেকেও হাজার হাজার মানুষ এখানে আসেন। দর্শক হিসেবে পাথর ছোঁড়ার লড়াইয়ে সামিলদের উৎসাহ বাড়াতে তারা চিৎকার করেন, স্লোগান দেন। আহত খেলোয়াড়রাও কিন্তু তাদের চোখ এড়িয়ে যায় না। এসব দৃশ্য অনেক সময় ক্যামেরাবন্দি হয়।
পান্ধুর্ণর বাসিন্দা অরবিন্দ থোমারে বলেন, “আমি ছোটবেলা থেকেই এই খেলায় অংশ নিচ্ছি। আমাদের কাছে এটা শুধু খেলা নয়, এটা গ্রামের গর্ব। আঘাত লাগাটা সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু জেতার আনন্দ তার চেয়ে অনেক বড়।”
বছর ৪৩-এর মি থোমরে জানিয়েছেন, তার মাথা ফেটেছে, মুখে আঘাত লেগেছে, নাক ভেঙেছে এবং ডান পাও ভেঙেছে। কিন্তু এতে অংশ নেওয়ার উৎসাহ একটুও দমেনি।
তারই পাশে দাঁড়িয়েছিলেন গোপাল বালপাণ্ডে। তার কথায়, “আমাদের কাছে এটা জীবনের চেয়েও বড় উৎসব।”
গত ১৬ বছর ধরে তিনিও এতে নিচ্ছেন। তার শরীরে আঘাতের চিহ্নও রয়েছে। অরবিন্দ থোমারে এবং গোপাল বালপাণ্ডের আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা অনেক তরুণই গোটমারেকে তাদের ‘পৌরুষ ও সাহস’ প্রদর্শনের মঞ্চ হিসেবে দেখেন।
নেপথ্যে এক প্রেম কাহিনী
স্থানীয়রা বলেন, এই পরম্পরা পুরোনো। বহু যুগ আগে পান্ধুর্ণর এক তরুণ ও সাবরগাঁওর এক তরুণী ভালোবেসেছিলেন একে অপরকে। এই সম্পর্ক ঘিরে দুই গ্রামের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে।
বলা হয়, গ্রামের মেয়েকে ফিরিয়ে আনার জন্য হাতে পাথর তুলে নিয়েছিলেন সাবরগাঁওর বাসিন্দারা। পান্ধুর্ণর বাসিন্দারাও চুপ থাকেননি। দুই তরফের এই লড়াইয়ে জাম নদী যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল।
সেই ঘটনাকে মনে রেখে নাকি পাথর ছোঁড়ার এই রেওয়াজ শুরু হয়, যা আজও চলছে।
স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিদের মতে ‘গোটমারের’ সূত্রপাত ৩০০ বছর আগে। যদিও এর স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ মেলেনি।
প্রতিবছর মেলার শুরু করেন সাবরগাঁওয়ের কাওলে পরিবার। তারা পলাশ গাছ কেটে এনে জাম নদীর মাঝখানে রোপণ করেন। সেখানে পুজোও করা হয়। পুজো শেষ হলে সকাল আটটা-ন’টা থেকে পাথর ছোঁড়া শুরু হয়।
জাম নদীর মাঝে পলাশ গাছটা রোপণ করেছেন সুভাষ কাওলে। তার কথায়, “কেন পাথর ছোঁড়া হয়, তার প্রমাণ আমার কাছে নেই। আমাদের পূর্বপুরুষরা পতাকা হিসেবে নদীর মাঝে গাছ রোপণ করতেন। সেই রেওয়াজই আমরা অনুসরণ করে চলেছি।”
রেওয়াজের ‘মাশুল’
গোটমার মেলার সাথে জড়িত প্রতিটা পরিবারের একটা করে নিজস্ব গল্প রয়েছে। পাথরবৃষ্টিতে কেউ পঙ্গু হয়েছেন, কেউ হারিয়েছেন প্রাণ।
জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, ১৯৫৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত পাথর ছোঁড়ার এই খেলায় অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
তাদেরই একজন ওই এলাকারই বাসিন্দা অমিত (নাম পরিবর্তন করা হয়েছে)। প্রায় এক দশক আগে গোটমার মেলায় তার মৃত্যু হয়। তার পরিবারে ছিলেন স্ত্রী ও চার সন্তান।
অমিতের এক সন্তান বলেন, “আমার বাবা গোটমার খেলতে গিয়েছিলেন। এখানকার লোকেরা বলে যে তিনি গোটমারের একজন পাকা খেলোয়াড় ছিলেন। কিন্তু একবার সেখানে তার মাথায় একটা পাথরের আঘাত লাগে। তখন আমরা খুবই ছোট ছিলাম। মেলায় বাবার মৃত্যু হয়েছিল।”
অমিতের পরিবারের জন্য গত দশ বছর খুবই কঠিন ছিল। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন তিনি। অমিতের মৃত্যু তার ছোট ছোট সন্তানদের জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনে।
পাথর ছোঁড়ার এই খেলাকে ঘিরে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তার পরিবারের সদস্যরা।
পরিবারের একজন বলেছেন, “প্রতি বছর এই উৎসবের সময় পুরোনো কথা মনে পড়ে যায়। মাঝে মাঝে মনে হয়, উনি থাকলে এটা হতো… ওটা হতো।”
“এই উৎসবকে এখন ভয় পাই আমরা। ওর চেহারাও আমার মনে নেই। আমার কাছে শুধু তার একটা ছবি রয়েছে।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন গ্রামবাসী জানিয়েছেন পাথরবৃষ্টির এই খেলায় কীভাবে তার ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছিল।
তিনি বলেছেন, “আমার ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে। গ্রামবাসীরা বলেন এটা না কি পরম্পরা! কিন্তু মায়ের চোখের জল তো কখনো থামবে না। পরম্পরা কি এতই বড়, যে তার জন্য কারো ছেলেকে বলি দিতে হবে?”
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে
গত কয়েক বছর ধরে এই মেলার ভিডিও ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব ও ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। বিনোদন হিসেবে বহু মানুষ শেয়ারও করেছেন এর ভিডিও।
পান্ধুর্ণর বাসিন্দা ধর্মেশ হিম্মতভাই পোপাট বলেন, “ভিড় বেড়েছে। তরুণরা একে বীরত্ব মনে করলেও এটা সমাজের জন্য লজ্জাজনক।”
পুলিশ জানিয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গোটমারকে ভাইরাল করে দিয়েছে। কিন্তু রক্তপাতও আরও বেড়েছে।
মহারাষ্ট্রের অমরাবতী থেকে প্রথমবার শ্বশুরবাড়িতে আসা ময়ূর চৌধুরী এর আগে ইউটিউবে গোটমার মেলার ভিডিও দেখেছেন। এইবার বিষয়টা একেবারে সামনে থেকে দেখতে এসেছেন তিনি।
মেলা শেষে মি. চৌধুরী বলেছেন, “এই খেলা খুবই বিপজ্জনক। জানি না কতজনের রক্ত ঝরেছে। সামনে থেকে খেলা দেখার সময় মনে হচ্ছিল এটা বন্ধ করা উচিত। একে কুসংস্কারও বলা যেতে পারে, তবে এখানকার লোকেরা বিষয়টার সঙ্গে পরম্পরাকে যুক্ত করেছেন।”
কেন বন্ধ করা যাচ্ছে না?
স্থানীয় ব্যক্তিদের অনেকেই জানিয়েছেন এই ঘটনায় শত শত মানুষের জীবন নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক পরিবারই তাদের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে প্রতিবন্ধী হতে দেখেছেন।
সবাই যে এই সহিংস পম্পরার পক্ষে, তেমনটা নয়। সাবরগাঁওয়ের বাসিন্দা বছর বিট্ঠল ভাঙ্গে তাদেরই একজন।
বছর ৭৩-এর প্রবীণ নাগরিক হাত জোড় করে বলেন, “আমার মনে হয় এটা বন্ধ হওয়া উচিত। এতে শুধু গরিব মানুষেরাই অংশ নেয়। যখন তাদের হাত-পা ভেঙে যায় বা তাদের মৃত্যু হয়, তখন পুরো পরিবারই বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক সমাজকর্মী বলেন, “এই মেলায় জুয়া ও বাজি ধরার ব্যবসা চলে। এখানে লক্ষাধিক টাকার চাঁদাও সংগ্রহ করা হয়। অনেকে এর আড়ালে নিজেদের শত্রুতার ঝাল মেটায়। কী করে এটা বন্ধ হবে?”
সাবরগাঁওয়ের বাসিন্দা ইসমাইল খানের বাড়ি নদীর মোহনায়। প্রতি বছরই গোটমারের চিহ্ন হিসেবে তার বাড়িতে পাথর পাওয়া যায়। মি. খান জানিয়েছেন, তরুণ বয়সে তিনিও এই খেলায় অংশ নিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, “গ্রামের সবাই এটা খেলেছে, আমিও খেলেছি। আজ আমার বয়স ৭৮ বছর। একবার আমার বুকে পাথরের আঘাত লেগেছিল। তারপর আমি খেলা বন্ধ করে দেই। আমার সন্তানরাও এই খেলায় অংশ নেয় না। প্রাণ হারানোর ভয় রয়েছে তো, তাই না?”
পুলিশ সুপার সুন্দর সিং কানেশ এই প্রসঙ্গে বলেন, “গত কয়েক বছর ধরে প্রশাসন গোটমারে সহিংসতার মাত্রা কমানোর চেষ্টা করেছে। এখানে বিশাল পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। আমরা প্লাস্টিকের বলও রাখার প্রস্তাব দিয়েছি, কিন্তু আমরা এটা পুরোপুরি বন্ধ করতে পারিনি। কারণ এখানকার মানুষ মনে করে এটা তাদের ঐতিহ্যবাহী খেলা।”
পান্ধুর্ণর এক সমাজকর্মী অন্য প্রশ্ন তুলেছেন।
তার কথায়, “প্রশাসন প্রতিবারই বলছে- নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্ছিদ্র। কিন্তু বাস্তবে মানুষ মদ্যপ অবস্থায় আসে, পাথর ছোঁড়ার এই খেলা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং তারপর সেই একই রক্তাক্ত চিত্র প্রকাশ্যে আসে।”
“সত্যি কথা বলতে, প্রশাসনও কোথাও না কোথাও এই পরম্পরার চাপে রয়েছে।”
এত প্রাণহানি, এত আঘাতের পরও গোটমার মেলা নিয়ে উৎসাহ একটুও কমেনি। সমান উৎসাহ নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় এই মেলা।
এর নেপথ্যে রয়েছে দুই গ্রামের পুরোনো শত্রুতা, পরম্পরার সঙ্গে হিংসা ও বিশ্বাসের যোগসূত্র, প্রশাসন ও নেতাদের মৌন সমর্থন এবং সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব।
তাই পরম্পরার আড়ালে প্রতি বছর ভিন্নমতের কণ্ঠস্বরগুলো চাপা পড়ে যায়। অব্যাহত থাকে রক্তপাত। আমরা যখন পান্ধুর্ণ ছেড়ে চলে আসছিলাম, তখন কয়েকশ যুবক পরের বছর আবার এই মেলায় আসার কথা বলছিল।
সূত্র: বিবিসি বাংলা


































