সোনাগাজী মডেল থানার সাবেক ওসি (বরখাস্ত) মোয়াজ্জেম হোসেনের নানা কুকীর্তি বিষয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছেন উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের ভুক্তভোগীরা। মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সখ্য, থানা এলাকায় দালাল সিন্ডিকেট, চাঁদা আদায়ের জন্য ক্যাশিয়ার নিয়োগ, মাদক মামলা দিয়ে নিরীহ জনগণকে জেলহাজতে প্রেরণ, সব ধরনের ছোট বড় যানবাহন থেকে মাসহারা আদায়সহ সকল ধরনের অপকর্মে নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছিলেন বিতর্কিত ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন।
সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাউদ্দৌলার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে মামলা করার পর নুসরাত জাহান রাফির পাশে দাঁড়াননি সোনাগাজী মডেল থানার তৎকালীন অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেন (বরখাস্ত)। উল্টো রাফির পরিবারের সদস্যদের বিভিন্নভাবে হেনস্তা করেছিলেন তিনি।
রাফির শ্লীলতাহানির ঘটনার পর জেরা করার নামে তাকে হয়রানি করে মোবাইল ফোনে সেই দৃশ্য ধারণ করেছিলেন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। এরপর ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তিনি ছড়িয়ে দেন।
অনুসন্ধান চালিয়ে জানা গেছে, অধ্যক্ষ সিরাউদ্দৌলাকে অভিযোগ থেকে রেহাই দিতে ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে চেয়েছিলেন ওসি মোয়াজ্জেম। এ কারণে রাফির শরীরে আগুন দেওয়ার পরও তিনি ঘটনাটিকে আত্মহত্যার চেষ্টা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। এবং এ ঘটনাটি আত্মহত্যার চেষ্টা বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বক্তব্য দিয়েছিলেন।
রাফিকে ওসির জিজ্ঞাসাবাদের ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, ওসির বিব্রতকর প্রশ্নে রাফি লজ্জায় পড়ে। নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে রাফি কেঁদে কেঁদে বলে, আলিম প্রথম বর্ষে পড়ার সময় তার গায়ে হাত দেয় একজন (নূর উদ্দিন)। অধ্যক্ষ সিরাজ পিয়নের মাধ্যমে তাকে ডাকেন। এরপর শরীরে হাত দেয়। ওসি রাফিকে তখন বলেন, ‘হাত দেওয়ার চেষ্টা করেছে?’ রাফি বলে, ‘না, দিয়েছেন। ’ ওসি তখন বলেন, ‘তুমি নিজে গেছ?’
এদিকে স্থানীয় ভুক্তভোগীরা বলছেন, সিরাজকে রক্ষা করতে তাঁর সহযোগীদের পক্ষ নিয়ে বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন দমন করতে চেষ্টা করেছিলেন ওসি মোয়াজ্জেম। সোনাগাজীতে ১৫ মাস ওসি থাকা অবস্থায় চাঁদাবাজি ও অপকর্মের সিন্ডিকেট তৈরি করেছিলেন তিনি। এর আগে তিনি ফেনীর ছাগলনাইয়া ও সদর থানায় ওসি ছিলেন। ছাগলনাইয়া থানায়ও অভিযোগ ওঠায় তাঁকে প্রত্যাহার করা হয়েছিল। সেখানে সোনার বার উদ্ধার করে গায়েব করে ফেলার অভিযোগ ছিল তাঁর বিরুদ্ধে।
ছাগলনাইয়ার সাংবাদিক নূরুজ্জামান সুমন বলেন, ২০১২ সালে ছাগলনাইয়ার কাশিপুর গ্রামের একটি বাড়িতে মামলার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ ভাঙচুর করে বলে অভিযোগ ওঠে। ওই বাড়ি থেকে সপ্তম শ্রেণিতে পড়া ১৩ বছরের এক শিশুকে আটক করে ১৮ বছর বলে গ্রেপ্তার দেখায়। অভিযোগটি প্রমাণিত হওয়ায় ওসিকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়।
সোনাগাজী শহরের রিকশাচালক মোশারফ হোসেন ও জয়নাল আবদিন ওসি মোয়াজ্জেম দুর্নীতির বিষয়ে বলেন, সোনাগাজী শহরে ব্যাটারিচালিত প্রতিটি রিকশার কাছ থেকে মাসে ২০০ টাকা করে চাঁদা নিতেন ওসি মোয়াজ্জেম। দরিদ্র রিকশাচালকদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবাদ করেছিলেন পৌরসভার মেয়র অ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলাম খোকন। তখন ওসি সাফ জানিয়ে দেন, টাকা না দিলে রিকশা চলবে না। রিকশাচালকরা এতে ক্ষুব্ধ হয়ে একদিন ধর্মঘটও ডেকেছিল। শেষে উপায় না পেয়ে টাকা দিয়েই রিকশা চালু করে তারা।
সোনাগাজী মডেল থানার পুলিশ ক্লিয়ারেন্স নিতে সরকারি খাতে ৫০০ টাকা জমা দেওয়ার পরও ২ হাজার ৭০০ টাকার বেশি দেওয়ার নিয়ম চালু করেছিলেন ওসি মোয়াজ্জেম। তিনি নিজেই নিতেন ১ হাজার। বাকি টাকা পুলিশ সুপার ও অন্য অফিসাররা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
উপজেলার আমিরাবাদ ইউনিয়নের পোল্ট্রি ব্যবসায়ী মো. শামিম বলেন, ২০১৮ সালে কোরবানির ঈদের ২দিন আগে ওসি মোয়াজ্জেমের নির্দেশে আমাকে কোনো ধরনের অভিযোগ ছাড়া অন্যায়ভাবে একদিন থানায় আটকে রেখে মিথ্যা মামলার ভয় দেখিয়ে আপনার পরিবারের সদস্যদের নিকট ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা আদায় করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপজেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির এক সদস্য জানায়, উপজেলায় প্রতি মাসে একটি আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হলেও ওসি মোয়াজ্জেম কখনো সে সভায় অংশগ্রহণ করতেন না।
তৎকালীন সময় ওসি মোয়াজ্জেমের নির্দেশে একজন সহকারী উপ-পরিদর্শক সে সভায় অংশগ্রহণ করতেন। এ নিয়ে একাধিকবার উপজেলা আইন-শৃঙ্খলা সভায় বাকবিতণ্ডাও হয়েছিল।
সোনাগাজীর উত্তর চরচান্দিয়া গ্রামের নুরুল আমিন ও আবদুল মান্নান জানান, মিথ্যা মামলায় জড়ানোর ভয় দেখিয়ে ওসি মোয়াজ্জেম গত জানুয়ারি মাসে তাদের নিকট থেকে জোর করে দুই লাখ টাকা করে আদায় করেছে।
সোনাগাজী সদর ইউনিয়নের মনগাজী বাজারের ব্যবসায়ী নূর ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, ওসি মোয়াজ্জেম আমাকে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার মিথ্যা অজুহাতে দুইদিন থানায় আটকে রেখে আমার পরিবারের সদস্যদের নিকট থেকে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা আদায় করেন।
এছাড়াও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওসি মোয়াজ্জেমের নির্দেশে তার নিয়োগপ্রাপ্ত ক্যাশিয়ার কনস্টেবল আবুল খায়ের মাদক ব্যবসায়ী, যানবাহন, ইটভাটা, করাতকল, বাজার ব্যবসায়ী, বালুমহল, মৎস্য আড়ৎসহ সমগ্র থানা এলাকা থেকে চাঁদা উঠিয়ে তাকে এনে দিতেন।
নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক এক ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, কোনো বাড়িতে ডাকাতির ঘটনা ঘটলে ওসি মোয়াজ্জেম থানায় মামলা নিতে চাইতেন না। ভুক্তভোগীরা খুব বেশি বিরক্ত করলে তিনি ডাকাতির ঘটনা চুরির মামলা হিসাবে রজু করতেন।
সৌজন্যে- কালের কণ্ঠ