
হলিউডে বড়সড় এক ঝড় বইয়ে দিয়ে নেটফ্লিক্স গতকাল (৫ ডিসেম্বর) ঘোষণা করেছে যে, তারা ৭২ বিলিয়ন ডলার দিয়ে ওয়ার্নার ব্রাদার্স ডিসকভারির চলচ্চিত্র ও স্ট্রিমিং ব্যবসা কিনে নিচ্ছে। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশি মুদ্রায় দাঁড়ায় প্রায় ৮ লাখ ৪২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। দীর্ঘ প্রতিযোগিতার পর দুই প্রতিদ্বন্দ্বী কমকাস্ট ও প্যারামাউন্ট-স্কাইড্যান্সকে পেছনে ফেলে চূড়ান্ত বিডার হিসেবে এগিয়ে যায় নেটফ্লিক্স।
স্ট্রিমিং, টেলিভিশন, সিনেমা হল—সব মিলিয়ে বিশ্বব্যাপী যে নতুন বিনোদন বাস্তবতা তৈরি হচ্ছে, এই চুক্তি সেই বাস্তবতাকে আরও বদলে দিতে পারে। একদিকে নেটফ্লিক্সের দ্রুত বিস্তার; অন্যদিকে ওয়ার্নার ব্রাদার্সের শতবর্ষের ঐতিহ্য—দুই শক্তি যুক্ত হলে গঠিত হবে এক অভূতপূর্ব সাম্রাজ্য।
চুক্তিতে কী কী থাকছে?
নেটফ্লিক্স কেবল ওয়ার্নার ব্রাদার্সের স্টুডিওই কিনছে না—এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে এইচবিও, এইচবিও ম্যাক্সের মালিকানাধীন বিপুল চলচ্চিত্র-টেলিভিশন লাইব্রেরি। এ তালিকায় রয়েছে ‘গেম অব থ্রোনস’, ‘দ্য সোপরানোস’, ‘হ্যারি পটার’, ‘ফ্রেন্ডস’, ‘দ্য বিগ ব্যাং থিওরি’, ডিসি ইউনিভার্সের বিশাল সুপারহিরো জগৎ। যে স্টুডিও বিশ্বের ‘ক্যাসাব্লাঙ্কা’, ‘সিটিজেন কেইন’-এর মতো সিনেমা বানিয়ে ছিল, তাদের পুরো ঐতিহ্য এখন নেটফ্লিক্সের ঝুলিতে।

চুক্তিটি নগদ অর্থ ও শেয়ারের সমন্বয়ে করা হয়েছে। প্রতি শেয়ারের মূল্য হয়েছে ২৭ দশমিক ৭৫ ডলার। মোট কোম্পানির মূল্য ধরলে (ঋণসহ) তা দাঁড়ায় ৮২ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারে। আর নগদ ও শেয়ার মিলিয়ে চুক্তির মূল্য ৭২ বিলিয়ন ডলার। দুই প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদই সর্বসম্মতভাবে চুক্তি অনুমোদন করেছে।
নেটফ্লিক্সের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ওয়ার্নার ব্রাদার্সের যেসব সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল, সেগুলো হলেই মুক্তি পাবে। যে স্টুডিও এখনো সিনেমা হলে মুক্তির ধারাকে গুরুত্ব দিয়ে আসছে, নেটফ্লিক্স সেই চর্চা ধরে রাখবে।
ওয়ার্নার ব্রাদার্সের প্রধান নির্বাহী ডেভিড জ্যাসলাভ বলেন, ‘এই চুক্তির মাধ্যমে বিশ্বের দুই সেরা গল্প বলার প্রতিষ্ঠান একজোট হচ্ছে।’

নেটফ্লিক্সের সহ-নির্বাহী প্রধান টেড সারানডস বলেন, ‘ওয়ার্নার ব্রাদার্সের অসাধারণ চলচ্চিত্র ও সিরিজের ঐতিহ্যের সঙ্গে আমাদের নিজস্ব কনটেন্টের সঙ্গে যুক্ত হলে আমরা দর্শকদের আরও বেশি কিছু দিতে পারব।’
উদ্বেগ আর আশঙ্কাও আছে
তবে এই খবর আনুষ্ঠানিক হওয়ার পর থেকেই বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে প্রবল বিতর্ক। ভারতীয় নির্মাতা দিবাকর ব্যানার্জির মতো ব্যক্তিত্বরা আগেই শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিলেন যে, বড় প্ল্যাটফর্মগুলো কার্যত সিনেমার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকছে। তাঁর মতো নির্মাতারা মনে করেন, প্ল্যাটফর্মগুলো বড় তারকা আর অ্যালগরিদমের পেছনে ছুটে নির্মাতাদের সেই গল্পই বলতে বাধ্য করবে, যা তাদের বলতে বলা হবে।
মার্কিন রাজনৈতিক মহল থেকে শুরু করে শিল্প সংগঠনগুলোও এই একীভূতকরণ নিয়ে তীব্র উদ্বেগ জানিয়েছে। রাইটার্স গিল্ড অব আমেরিকা (WGA) এই সমঝোতাকে কর্মী ও ভোক্তা—দুই পক্ষের জন্যই নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে উল্লেখ করে এটি বন্ধ করার দাবি জানিয়েছে। তাদের অভিযোগ, এই চুক্তি চাকরি কমাবে, মজুরি কমাবে, কর্মপরিবেশ খারাপ করবে, গ্রাহকদের খরচ বাড়াবে এবং কনটেন্ট বৈচিত্র্য কমিয়ে দেবে।
সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেন একে ‘বিশাল একচেটিয়া বাজার’ আখ্যা দিয়ে বলেছেন, এর ফলে সাবস্ক্রিপশন দাম বাড়বে, পছন্দ করার সুযোগ কমবে, আর কর্মীদের চাকরি ঝুঁকি বাড়বে। অভিনেতাদের ইউনিয়ন স্যাগ-আফট্রাও বলেছে যে এ ধরনের বড় চুক্তি সৃজনশীল কর্মীদের আয় ও ক্যারিয়ারকে সংকটে ফেলতে পারে।

সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত সিনেমা হল মালিকেরা। সিনেমা ইউনাইটেডের প্রধান নির্বাহী মাইকেল ও’লিয়ারি একে বিশ্বজুড়ে সিনেমা ব্যবসার জন্য ‘অভূতপূর্ব হুমকি’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাঁদের ভয়, নেটফ্লিক্স সিনেমা হল নিয়ে তেমন মাথা না ঘামানোর কারণে ওয়ার্নারের বড় বাজেটের ব্লকবাস্টারগুলো ভবিষ্যতে সরাসরি স্ট্রিমিংয়ে চলে যেতে পারে, যা সিনেমা হল ব্যবসা বড় ধাক্কা খেতে পারে।
যদিও নেটফ্লিক্স জানিয়েছে , ওয়ার্নার ব্রাদার্সের যেসব সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল, সেগুলোর হল রিলিজের ধারা তারা ধরে রাখবে, তবুও এই একচেটিয়া ক্ষমতা তৈরির শঙ্কা বিশ্বব্যাপী সিনেমা দুনিয়ায় এক বড় প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিয়েছে।








































