Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

ফেসবুক অ্যাডিকশনের লক্ষণ ও উত্তরণের উপায়

facebook
প্রতিকী ছবি

আপনি কি ফেসবুকে খুব আসক্ত? ফেসবুকে একদিন না বসলে দুনিয়াদারির কিছু ভালো লাগে না? পেটের ভাত হজম হয় না? পরিচয় সংকটে ভোগেন? কেমন কেমন যেন লাগে? তবে জেনে নিন, আপনি ফেসবুক অ্যাডিকশন ডিসঅর্ডারে ভুগছেন! আপনার মানসিক স্বাস্থ্য হুমকির মুখে! এক্ষুণি এ বিষয়ে সতর্ক না হলে আপনি অদূর ভবিষ্যৎতে বিভিন্ন মানসিক জটিলতায় ভুগবেন। এমনকি বিভিন্ন শারীরিক উপসর্গও দেখা দিতে পারে।

বলা যায় না, এখনই হয়তো এমন কোন জটিলতায় আছেন যা নিজেই বুঝতে পারছেন না যে ফেসবুকের কারণেই হচ্ছে! তাই আপনার জন্য এবং যাদের ফেসবুক প্রীতি এখনও সীমা অতিক্রম করেনি তাদের জন্য এই শখের মনোবিদ কিছু পরামর্শ নিয়ে হাজির হয়েছে।

chardike-ad

ফেসবুক অ্যাডিকশন থেকে মুক্ত হতে হলে প্রথমেই স্বীকার করে নিন আপনি একজন ফেসবুক অ্যাডিক্ট। সমস্যা হল, ফেসবুক অ্যাডিক্টরা তাদের এই অ্যাডিকশনের কথা স্বীকার করতে চায় না, যেমনটা চায় না ড্রাগ অ্যাডিক্টরা। ফেসবুক অ্যাডিক্টদের যে সব আচরণের কথা এখানে উল্লেখ করছি, তারা আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে সেসবের মনগড়া ব্যাখ্যা দিতে চায়। নিজে যে ফেসবুক অ্যাডিক্ট না, সাধারণ একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী সেটা প্রমাণ করতে উঠে-পড়ে লাগে। কিন্তু এখানে যে সব ফেসবুক অ্যাডিকশনের লক্ষণ উঠে আসছে সেসব যদি আপনার মধ্যে বিদ্যমান থাকে তবে নিজেকে ফেসবুক অ্যাডিক্টেড বলে স্বীকার করে নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। রোগমুক্ত হতে হলে আগে রোগটা চিহ্নিত করে নিতে হয়, তারপর চিকিৎসা। যদি মনে করেন আপনি এখনও ফেসবুক অ্যাডিকশনের শিকার হননি তবে এই অভাজনের পরামর্শগুলো আপনাকে নিরাপদ ফেসবুক ব্যবহারে সহায়তা করবে।

ফেসবুক অ্যাডিকশনের লক্ষণ ও উত্তরণের উপায় ছাড়াও ফেসবুকে কি করা উচিত ও কি করা উচিত না সে বিষয়েও আলোকপাত করা হল:

১। ফেসবুককে আপনার জীবনের সমস্ত ধ্যানজ্ঞান মনে করবেন না। ফেসবুকের সাফল্য আপনার জীবনের প্রকৃত সাফল্য নয়। ফেসবুকের চেয়েও জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে যা আপনি এখন হয়তো অবহেলা করছেন, সেসব বিষয়ে নজর দিন। মনে রাখবেন, আপনার মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য ফেসবুকের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

২। ফেসবুকের অতি ব্যবহার হিংসা, বিদ্বেষ, দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ, ইত্যাদি ক্ষতিকারক মানসিক অনুভূতি সৃষ্টি করে। এমনকি আপনাকে বিষণ্ণতায় আক্রান্ত করতে পারে, প্রকৃত কর্মক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে। অতএব, এসব থেকে বাঁচতে হলে এখনই সাবধান হতে হবে। নতুবা পরে শুধু আফসোসই করতে হবে।

৩। যখন-তখন পিসিতে বিশেষত মোবাইলে ফেসবুক চেকিং আপনার স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাপকভাবে ব্যাহত করবে। আপনাকে বাস্তব জীবনের প্রতি উদাসীন ও অমনোযোগী করে তুলবে। অন্য কিছুতে সহজে মন বসাতে পারবেন না। ফেসবুক বন্ধুদের সাথে কানেক্টেড থাকতে গিয়ে বাস্তব সম্পর্কগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন। তাই চিন্তা করে দেখুন যা করছেন তা কতটুকু ভালো করছেন।

৪। আপনি আসলে যা না ফেসবুকে তা সাজার ভাণ করবে না। বিভিন্ন ভাণ ধরে আপনি হয়তো আপাতত মজা পাচ্ছেন। কিন্তু এই ভাণ ধরে থাকার ফলে আপনাকে পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার রোগে ধরবে। কিংবা ইতিমধ্যে হয়তো আপনি দ্বৈত ব্যক্তিত্বজনিত সমস্যায় আক্রান্ত। ফেসবুকে নিজেকে অতি আকর্ষণীয়, বুদ্ধিমান, এন্টারটেইনিং, মহাজ্ঞানী হিসেবে প্রমাণ করতে গিয়ে আপনি বিভিন্ন ছলচাতুরীর আশ্রয় নিচ্ছেন, যা আপনার ব্যক্তিত্বকে সঙ্কটে ফেলছে।

৫। ফেসবুকে যারা ঘনঘন ঢু মারে তারা একটা ঘোরের মধ্যে থাকে। ঘনঘন ফেসবুকে ঢু মারবেন না। বারবার নোটিফিকেশন চেক করবেন না। দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট সময়সীমার জন্য ফেসবুক ব্যবহার করুন। তা না হলে আপনার মানসিক ধৈর্য ও স্থিতি হ্রাস পাবে। দিনে এক ঘণ্টার বেশি সময় ফেসবুকে ব্যয় না করাটা সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর।

৬। প্রতিদিন একবার অবধারিতভাবে বা একদিনে অনেক বার স্ট্যাটাস আপডেট করতেই হবে তা না হলে অনলাইনে আপনার অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়বে- এমন অস্বাস্থ্যকর সংকীর্ণ চিন্তা এক্ষুণি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিন। লোকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করার যে স্বাভাবিক প্রবৃত্তি মানুষের আছে সেটা লাগাম ছাড়া হতে দিবেন না। নয়তো এক সময় আবিষ্কার করবেন একা থাকার যে স্বাভাবিক ক্ষমতা আছে সেটা হারিয়ে ফেলছেন। নির্জনতা আপনার কাছে নিদারুণ অসহ্য লাগবে।

৭। ফেসবুকে মিথ্যা বা অসত্য বা বানোয়াট বা অর্ধসত্য বা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে কথা বলার চর্চাটা বেশি হয়। নিজেকে জাহির করার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। এসব হয়তো আপনাকে অন্যের কাছে তথাকথিত জনপ্রিয় করছে, কিন্তু আসলে আপনি নিজের কাছে নিজেই ছোট হচ্ছেন। নিজের প্রতি সৎ থাকুন। আত্মসম্মান বজায় রাখুন।

৮। এমন কোন ছবিতে কাউকে ট্যাগ করবেন না, যে ছবিটি তার নয়। অযথা লোকজনকে ট্যাগ করা বন্ধ করুন।

৯। ফেসবুকে নিজেকে ওভার শেয়ার করবেন না। আপনার ঘনঘন স্ট্যাটাস আপডেটিং, ফটো শেয়ারিং, বিভিন্ন পোস্ট শেয়ারিংয়ের ফলে বন্ধু তালিকার
বন্ধুদের নিউজ ফিড যদি জ্যাম হয়ে যায় তবে আপনি তাদের কাছে একজন বিরক্তিকর ফেসবুক ইউজার হিসেবে চিহ্নিত হবেন। সো সেইভ ইউর ইমেজ।

১০। কারও স্ট্যাটাস কপি পেস্ট করবেন না। দয়া করে শেয়ার বাটনটি চাপুন।

১১। কারও সঙ্গে ব্যক্তিগত বিষয়ে কথাবার্তা ওয়ালে না বলে ম্যাসেজে বলুন।

১২। ফেসবুকের জনপ্রিয়তা অনুসারে মানুষ বিচার করবেন না। অনেক বিখ্যাত মানুষ আছেন যারা স্রেফ ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ফেসবুক ব্যবহার করছেন। বন্ধু/ফলোয়ার সংখ্যা, লাইক/কমেন্ট/শেয়ার এসব কারও কর্মজীবন বিচারের মানদণ্ড না। অনেক বিখ্যাত লেখক ও ব্লগারও আছেন যারা ফেসবুকে একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে থাকেন। পাবলিক রিলেশনের চেয়ে তারা হয়তো প্রাইভেট রিলেশনে অধিক গুরুত্ব দেন। ফেসবুকে আপনার অবস্থানটা হয়তো বড়, তাই বলে বাকিদেরকে ছোট ভাবার কোন কারণ নেই। অন্যদের প্রতি সম্মান বজায় রাখুন।

১৩। আপনি যত বড় আদমি হোন না কেন, কেউ আপনাকে ম্যাসেজ করলে দেরিতে হলেও সেটার রিপ্লাই দিন। এটা নূন্যতম ভদ্রতা জ্ঞানের পরিচয়।

১৪। ফেসবুকে আপনি কি ‘লাইক’ করছেন সেটা খুব খেয়াল করে করুন। আপনার এই ‘লাইক’ কিন্তু আপনার ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করে। আপনি কোন চটি পেজে বা পর্ণো ছবির পেজে লাইক দিয়ে বসে আছেন, ভুলে যাবেন না সেটা অন্যদের নিউজ ফিডেও চলে আসছে, আপনার প্রোফাইল ঘাঁটলেও যা পাওয়া যাবে। নিজে বিব্রত হতে না চাইলে বা অন্যদেরকে বিব্রত করতে না চাইলে সাবধানে ‘পছন্দ’ করুন।

১৫। ফেসবুকে কি স্ট্যাটাস দিবেন সেটা নিয়ে যদি দীর্ঘক্ষণ বসে বসে চিন্তা করেন, নিজেকে একজন ফেসবুক অ্যাডিক্ট বলে চিনে নিন। আপনি চিন্তা করছেন এটা দিলে লোকজন পছন্দ করবে কিনা, লাইক কি আগের স্ট্যাটাসের চেয়ে বেশি হবে না কম, কমেন্ট কেমন আসতে পারে, শেয়ার কেমন আসবে এসব চিন্তা করে একটা স্ট্যাটাস আপডেট করার মানে দাঁড়ায় আপনি নিজেকে অন্যদের কাঠগড়ায় বিচারের মুখে ফেলছেন। ফলাফল যা হচ্ছে সেটাকে আপনি রায় হিসেবে নিচ্ছেন। অর্থাৎ আপনার নিজের গ্রহণযোগ্যতা বিচারে আপনার নিজের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। আপনি চরম ব্যক্তিত্ব সংকটে ভুগছেন। জাস্ট বি ইওরসেল্ফ। নিজেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ করাটাই আপনার আসল ‘স্ট্যাটাস’। পারফেক্ট স্ট্যাটাস বলে কিছু নেই, যেমন নেই পারফেক্ট মানুষ।

১৬। আপনি অনলাইন সোশাল লাইফে যতো বেশি সক্রিয় হবেন অফলাইনের সামাজিক জীবনে ততো বেশি নিষ্ক্রয় হবেন। তার মানে আপনি যতোটা না মানুষ থাকছেন তার চেয়ে বেশি যন্ত্রে পরিণত হচ্ছেন। অফলাইনের চেয়ে অনলাইন হয়ে যাচ্ছে আপনার সবচেয়ে কমফোর্ট জোন। প্রকৃত সামাজিক জীবনে আপনি স্বস্তি বোধ করছেন না। অধঃপতন হচ্ছে আপনার বাস্তব জীবনের। তাই সপ্তাহে অন্তত টানা দুইদিন ফেসবুক ব্যবহার বন্ধ রাখুন। বাস্তব জীবনটা পূর্ণমাত্রায় উপভোগ করুন। সাতদিনে দুদিন ফেসবুক ব্যবহার না করলে আপনার জীবনহানি হবে না। বরঞ্চ ফেসবুকের কারণে জীবন, সম্পর্ক ও মাথা গোল্লায় যাওয়ার রেকর্ড আছে।

এই লেখাটির উদ্দেশ্য আপনাকে ফেসবুক বিমুখ বা ফেসবুক বিদ্বেষী করে তোলা না। ফেসবুকের ক্ষতিকারক দিকগুলো সম্পর্কে সচেতন করে তোলা। অবশ্যই আপনি যোগাযোগ, আনন্দ লাভ, তথ্য জানার মাধ্যম ও নানাবিধ গঠনমূলক কাজের জন্য ফেসবুক সুবিধা ব্যবহার করবেন। কিন্তু ফেসবুক যেন কোনভাবে আপনার ক্ষতি করতে না পারে। ফেসবুক অ্যাডিকশন ডিসঅর্ডার সম্পর্কে নিজেকে সচেতন হতে হবে অন্যদেরকেও সচেতন করতে হবে। এই লেখাটি একবার পড়লেই যে আপনি ফেসবুক অ্যাডিকশন থেকে মুক্ত থাকবেন বা মুক্ত হয়ে যাবেন তা কিন্তু না। লেখাটি আবার পড়ুন, কিছু দিন পরপর বারবার পড়ে মগজে গেঁথে নিন। কথাগুলোকে কাজে পরিণত করুন। আপনার ফেসবুক ব্যবহার আসক্তিমুক্ত সুস্থ ও আনন্দময় সুন্দর হোক!