Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

উন্নয়নে পরিত্যক্ত জনগোষ্ঠী সাঁওতাল

base_1479238748-saotal

ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচীনতম অধিবাসীদের অন্যতম সাঁওতাল। কারো কারো মতে, আর্যদেরও অনেক আগে থেকে এ উপমহাদেশে বসবাস তাদের। আর বাংলাদেশে সাঁওতালরা বাস করে মূলত উত্তরাঞ্চলে। বহুকাল ধরে এ অঞ্চল আঁকড়ে আছে তারা। স্বাধীনতার পর জীবনমানের উন্নয়ন হবে সব নাগরিকের মতো, এমন প্রত্যাশা ছিল সাঁওতালদের মধ্যেও। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেলেও সাঁওতালদের অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। কমেছে তাদের সংখ্যাও।

chardike-ad

একসময় শতভাগ সাঁওতাল পরিবারের জমিতে অধিকার থাকলেও এখন সে অবস্থা নেই। বেসরকারি সংস্থা কারিতাস পরিচালিত ২০০৪-০৫ সালের জরিপ অনুযায়ী, কোনো বসতভিটা নেই ৬৬ দশমিক ২৯ শতাংশ সাঁওতাল পরিবারের। কৃষিজীবী হলেও ৭৩ দশমিক ৯০ শতাংশ পরিবারেরই চাষ করার মতো কোনো জমি নেই। বসতভিটা বা কৃষিজমি— এ দুটির যেকোনো একটি রয়েছে মাত্র ৩৭ দশমিক ১৩ শতাংশ সাঁওতাল পরিবারের। অর্থাৎ ৬২ দশমিক ৮৭ শতাংশ সাঁওতাল পরিবারেরই কোনো ধরনের জমি নেই।

উত্তরবঙ্গের ছয় জেলার ১৩টি উপজেলার ৮ হাজার ৪৫৪টি সাঁওতাল পরিবারের তথ্যের ভিত্তিতে জরিপটি পরিচালনা করে কারিতাস। এতে পঞ্চগড় জেলার আতওয়ারি, ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী, পীরগঞ্জ ও রানীশংকৈল, দিনাজপুরের পার্বতীপুর, হাকিমপুর, বিরামপুর ও ঘোড়াঘাট, রংপুরের মিঠাপুকুর, পীরগঞ্জ ও বদরগঞ্জ, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ ও জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার সাঁওতালদের তথ্য ব্যবহার করা হয়।

এক দশক আগের জরিপে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর যে চিত্র বেরিয়ে এসেছে, বর্তমানে সে অবস্থায় কী পরিবর্তন হয়েছে, খোঁজ করতে গিয়ে বণিক বার্তার পক্ষ থেকে মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধান ও তত্কালীন জরিপ কমিটির চেয়ারম্যান ফাদার মার্কাস মুরমুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সব উত্সই নির্দেশ করে যে, বর্তমানে সাঁওতালদের অবস্থা আগের চেয়ে আরো অবনতি হয়েছে।

ফাদার মার্কাস মুরমু এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, সাঁওতালদের মধ্যে ভূমিহীনের সংখ্যা এখন আরো অনেক বেড়েছে। পরে আর জরিপ না হলেও ভূমিহীন সাঁওতালের সংখ্যা এখন ৭০-৭৫ শতাংশ হবে।

এ ভূখণ্ডে সাঁওতালদের আগমন ও পরবর্তীতে তাদের প্রান্তিকতা নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের একাধিক শিক্ষকের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে জানা যায়, সাঁওতাল পরিবারের প্রধান পেশা ছিল পশুপালন ও কৃষি। বনজঙ্গল পরিষ্কার করে এ দেশের অধিকাংশ জমিই চাষ উপযোগী করেছে তারা। নিজস্ব দলিল ছাড়াই সে জমির ওপর সম্পূর্ণ অধিকার ভোগ করত সাঁওতালরা। যে যতটুকু জমি চাষ করত, ততটুকু জমিতেই ছিল তার অধিকার। ধীরে ধীরে তাদের জমি চলে যায় অন্যের দখলে। জমিদাররা নিয়ে নেন গায়ের জোরে আর মহাজনরা ঋণের ফাঁদে ফেলে। পরবর্তীতে সরকারি অধিগ্রহণ ও স্থানীয় প্রভাবশালীরাই বিভিন্ন কৌশলে তাদের জমি দখল করে। জোরপূর্বক দখল ও জাল দলিল তৈরি করে কৌশলে আয়ত্তসহ বিভিন্ন সময় সরকারি অধিগ্রহণের নামে ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়েছে সাঁওতালরা। সামাজিক বনায়নের জন্যও রংপুর ও দিনাজপুরে ভূমিহীন হয়েছে অনেক সাঁওতাল পরিবার।

নৃবিজ্ঞানী অধ্যাপক প্রশান্ত ত্রিপুরা বলেন, ‘আদিবাসীদের ভূমি হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে তাদের প্রান্তিকতার কারণে। এ ব্যাপারে রক্ষাকবচ হিসেবে যে আইন ও সরকারি সদিচ্ছা থাকা দরকার, তা নেই। মৌখিক আশ্বাস সব সরকারই দিয়েছে। তবে প্রকৃতপক্ষে যথাযথ আইনি ও নীতিনির্ধারণী পরিকাঠামো ও তার জন্য যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার তার ঘাটতি রয়েছে।’

জমি হারানোর পাশাপাশি দেশ ত্যাগের ফলে সাঁওতালদের সংখ্যাও কমছে। ১৯৪১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, বাংলাদেশ অংশে সাঁওতালদের সংখ্যা ছিল আট লাখ। সর্বশেষ ২০১১ সালের শুমারিতে এ সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১ লাখ ৪৩ হাজার ৪২৫-এ। অথচ ১৯৯১ সালের শুমারিতেও সাঁওতালদের সংখ্যা ছিল ২ লাখ ২ হাজার ১৬২। যদিও সাঁওতালদের প্রকৃত সংখ্যা সবসময়ই কমিয়ে দেখানো হয়েছে বলে মনে করেন গবেষকরা।

সর্বশেষ ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি সাঁওতাল বসবাস করে দিনাজপুরে ৪৯ হাজার ৮৬১ জন। এরপর রাজশাহীতে ২৬ হাজার ৪৬৯ ও নওগাঁয় ২৪ হাজার ৪০৯ জন সাঁওতাল বসবাস করে। এছাড়া হবিগঞ্জে ৬ হাজার ৪৫০, ঠাকুরগাঁওয়ে ৬ হাজার ৩৮২, মৌলভীবাজারে ৬ হাজার ২৪৫, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৬ হাজার ২২৮, রংপুরে ৫ হাজার ৬৪৫, গাইবান্ধায় ৩ হাজার ৮৭, জয়পুরহাটে ২ হাজার ৬৮৯, নাটোরে ২ হাজার ৪৯৬, পঞ্চগড়ে ৯২০, বগুড়ায় ৮৮১, সিরাজগঞ্জে ৬২১, চুয়াডাঙ্গায় ৫৯০, সাতক্ষীরায় ১০৫, নীলফামারীতে ৯ ও মেহেরপুরে আটজন সাঁওতালের হিসাব পাওয়া যায়।

১৮৮১ সালের আদমশুমারি থেকে পাবনা, যশোর, খুলনা ও চট্টগ্রাম জেলায় কিছুসংখ্যক সাঁওতালের বসবাসের তথ্য পাওয়া যায়।

নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী নিয়ে গবেষণা করেন ফিলিপ গাইন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৬টি জেলায় মূলত সাঁওতালদের বসবাস। তবে দেশের বিভিন্ন স্থানে আরো কিছু সাঁওতাল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। প্রকৃতপক্ষে সাঁওতালের সংখ্যা চার লাখের কাছাকাছি হলেও সরকারি পরিসংখ্যানে কম দেখানো হয়। সাঁওতাল পরিবারগুলোর ৬০-৬৫ শতাংশ একেবারেই ভূমিহীন। দুই-তৃতীংশের কৃষিজমি নেই। তাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা ভূমি। তারা পরের জমিতে বিশেষ করে সরকারি খাস জমিতে থাকে। যখন স্থানীয় প্রভাবশালীরা তা দখলে নিতে চায়, তখন তারা নির্যাতিত হয়, স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হয়।

দারিদ্র্যের পাশাপাশি শিক্ষায়ও পিছিয়ে আছে সাঁওতালরা। মাত্র ১০ শতাংশ সাঁওতাল লিখতে ও পড়তে পারে বলে বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়।