Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

শতবর্ষী স্কুল রোসাংগিরী উচ্চ বিদ্যালয়ের স্মৃতি

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী ফটিকছড়ি উপজেলার শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ আমার প্রিয় স্কুল রোসাংগিরী উচ্চ বিদ্যালয়। স্রষ্টার অপার রূপের ফটিকছড়িতে হালদা নদীর পাশে শতবর্ষব্যাপী আমার প্রিয় বিদ্যালয় আলোকিত মানুষ তৈরীর প্রাণকোষ। প্রাদপ্রদীপের ন্যায় প্রকৃতির লীলাভূমি ফটিকছড়ি উপজেলায় রোসাংগিরী গ্রামের এ বিদ্যালয়টি কালের সাক্ষী হয়ে স্বগৌরবে জ্ঞানের আলো বিকিরণ করে যাচ্ছে। প্রাণপ্রিয় স্কুলটি ১৯১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত; বর্তমানে ইতিহাসের নানান গলিপথ বেয়ে সময়ের পরিক্রমায় শতবর্ষে পদার্পণ করল।মননজুড়ে, অনুভবের সীমানায় অনুরণনেরর দোলায় আজও চিরভাস্বর হয়ে আছে প্রিয় স্কুলের স্মৃতি। সবুজ অরণ্য, হালদা নদীর পাড়, শফি ভাইয়ের দোকানের সিংগারা, চপ স্কুলের আঙিনায় জমে থাকা স্মৃতি যেন ইতিহাস! এ যেন মুঠো কাব্য কবিতা,মুঠো উপন্যাস!

আমার স্কুলের প্রবেশ পথের সবুজ ঘাঁসগুলো যখন মনের রূপকে পবিত্র করে দিত; তখনি আনন্দ অনুভব হতো। বিদ্যালয়ের সম্মুখের মাঠটি, পোষ্টঅঅফিসের কোল ঘেয়ে বটগাছটি এখনও স্মৃতিতে সৌরভ বিলায়। মসজিদের পাশে পুকুরটি স্বচ্ছ নীলিমা ছড়ায়। বিদ্যালয়ের তিন দিকে সবুজাভ পরিবেশ এক অনবদ্য রূপ লাবণ্য দান করতো। বিকেলে যখন স্কুল মাঠে খেলতে যেতাম তখন শুনশান নীরবতায় মনে হতো এ স্কুল শত নায়কের জন্মদাতা। মরহুম আলাউদ্দিন স্যার, হাবীব স্যার সম্পর্কে আমার মামা,হাসান স্যার, শফি হুজুর, নারায়ণ স্যার,প্রধান শিক্ষক হারুণ স্যার, রুবেল স্যার, হাসান স্যার, প্রফুল্ল স্যার, সহ সকলে জগত আলোড়িত দীক্ষক ও মহান শিক্ষক। অ্যাসেম্বলীর সময় সারি সারি দাঁড়ানোর জন্য আলাউদ্দিন স্যার ও হাসান স্যারের প্রয়াস ভুলবার নয়। বিশাল আয়তনের ঐতিহাসিক মাঠ যা বর্তমানে বাংলাদেশের অন্য কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আছে কিনা সন্দেহ রয়েছে।

chardike-ad

rosangiriস্কুলটি যেমন ঐতিহ্যের সাক্ষী। তেমনি স্কুলের মাঠটিও ইতিহাসের অনন্য সাক্ষী। বড় টুর্ণামেন্টের অনেক আয়োজন এখানে হয়। আমাদের মাঠটি থেকে যেমন বের হয়েছে ভাল খেলোয়াড় তেমনি স্কুল থেকে বের হয়েছে অধ্যাপক, ব্যাংকার, শিক্ষক, শিল্পী, গায়ক, কলামিস্ট, ব্যবসায়ী, সরকারী কর্মকর্তা, এনজিও কর্মী,রোটারিয়ান,প্রবাসে সফল ব্যক্তিত্ব, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব , সাংবাদিকসহ অনেকে। উনারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন নীরবে, নিভৃতে, কিছুটা সরবে। এই স্কুলকে ঘিরেই গড়ে ওঠে রোসাংগিরী প্রাথমিক বিদ্যালয়, পোষ্ট অফিস, রোসাংগিরী ইউনিয়ন, রোসাংগিরী শীলের হাট, রোসাংগিরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও একটি মেডিকেল সেন্টার।

২০০০ সালে স্কুলের গন্ডি ছেড়ে চলে এসেছি কিন্তু ভুলতে পারিনি সে স্মৃতিকথা। ভুলতে পারিনি স্কুলের সহপাঠীদের, খালাত ভাই মোশাররফ হোসেন বাবর, রহমত আলী, রোকন উদ্দীন, বিবেক সরকার, সঞ্জয়, ইয়াসমিন, সাবরিনা, রিনা, গিয়াস উদ্দীন, এয়ার মোহাম্মদ, প্রিয় বন্ধু মেজবাহ, সোহেল, তুলি, মোশাররফকে শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মন্ডলীদেরকে , অফিস সহকারী সহ স্কুলের ধূসর দালান আর চুন খসে যাওয়া দেয়াল সবকিছুই যেন স্মৃতির পাতায় জীবন্ত, প্রাণবন্ত হয়ে আছে এখনও। মনে পড়ে স্কুলের সেই দুরন্তপনা, বন্ধুদের সাথে হৈ হুল্লোড়! ছুটিয়ে আড্ডা দেয়া, একসাথে টিফিন খাওয়া,কখনো কখনো স্কুল ফাঁকি দেয়া, মেয়েদের দিকে উঁকি দেয়া,কখনো প্রথম বেঞ্জে কখনো মাঝ বেঞ্জে বসা, আলাউদ্দীন স্যারের কপোতাক্ষ নদ পড়ানো মাস্টারিং আর্ট এখনো মনে পড়ে, মনে পড়ে নারায়ণ স্যারকে ঠকানোর কথা ইত্যাদি ইত্যাদি। এখনো মনে পড়ে হাবীব স্যার, হাসান স্যারের দেয়া হোম টাস্ক যেদিন রেডি না করে ক্লাসে আসতাম সেদিন ক্লাসে স্যারের কাছ থেকে মুখ লুকানো কথা। মনে পড়ে প্রাণপ্রিয় শিক্ষক আলাউদ্দিন স্যারকে ; যাকে কিছুদিন আগে হারিয়েছি। আরো অনেক শিক্ষক মহোদয়গণকে হারিয়েছি; যারা এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন। বিনম্র শ্রদ্ধা উনাদের প্রতি। আজ খুব মনে পড়ে আইউব স্যারের কথা যিনি দরদ দিয়ে ইংরেজি গ্রামার শিখাতেন। স্যার অনুগ্রহ করে ক্ষমা করে দিবেন আমাদেরকে, আপনাদের ক্লাসে দুষ্টুমি করে আপনাদেরকে অনেক বিরক্ত করতাম।

প্রিয় সম্মানিত শিক্ষক মন্ডলী আপনারা আমাদের পথ প্রদর্শক। আপনাদের কথা আজও মানসপটে ভেসে উঠে জীবন্ত হয়ে,শিশির ভেজা সকালের সূর্যের ন্যায়। এখন কেউ কেউ স্কুলে নেই, কেউ অবসর জীবনে আছেন, কেউ স্রষ্টার কাছে, আর সেই সময়ের হাবীব স্যার, হাসান স্যার, রুবেল স্যার, শফি হুজুরএখনও স্কুলটির হাল ধরে আছেন। শ্রদ্ধা আর অফুরান ভালবাসা আপনাদের জন্য। উনাদের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে স্কুলটি এগিয়ে আছে আগামীর প্রত্যাশা পূরণে। স্কুলটি দাঁড়িয়ে থাকুক, বেঁচে থাকুক, আলো ছড়াক যুগ থেকে যুগান্তরে হাজার বছর ধরে। কৈশোরের ফেলে আসা স্কুল জীবনটা যদি আবার ফিরে পেতাম! যদি আবার মিশে যেতো পারতাম একে অপরের সাথে আনন্দে ও নিষ্পাপ ভালবাসায়! যদি বন্ধুদের সাথে হালদা পাড়ে বসে কিংবা স্কুলের পুকুর পাড়ে চুটিয়ে আড্ডা দিতে পারতাম, বাবর, মেজবাহ, সোহেলের সাথে যদি মদীনার দোকানে, শফি ভাইয়ের দোকানে পরাটা সিংগারা খেতে পারতাম! যদি পারতাম স্কুল মাঠে বন্ধুদের সাথে ক্রিকেট, ফুটবল খেলতে,যদি মঞ্জুকে বলতে পারতাম স্কুলের ডাব গাছ থেকে একটা ডাব পেরে দেয়! জানি যা চলে গেছে তা আর ফিরে আসবে না! আসবে না সে স্কুল জীবন! তবু প্রিয় স্কুলের স্মৃতি এখনও ধরা দেয় এক নির্মল আনন্দের প্রতিচ্ছবি হয়ে! তাইতো খুঁজে ফিরি স্কুল বন্ধুদের চেনা মুখ, কারো পানে তাকিয়ে দেখা আঁড় চোখ, দুষ্ট কোন খুনশুটি! কৈশোরিক উন্মাদনায় এখনও খুঁজি স্মৃতির ডায়েরীতে অম্লান স্কুল জীবনের সময়গুলি! কৈশেরের দুরন্তপনা! স্কুলের ব্যাগ খালের পাড়ে রেখে খালের পানিতে ঝাঁপ দেয়া! কত কাব্যিক ইতিহাস।হাতড়ে বেড়ায় বন্ধু সঞ্জয়,বিবেককে যাদের নিয়ে ঘুরতাম পুরো শীলের হাট! কোথাও বন্ধুদের সাথে দেখা হলে ; কান পাটানো চিৎকার!  ইস! মিস করছি! সত্যিই মিস করছি!

আজ কর্মজীবনে দেশ ছেড়ে প্রবাসে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলের মাটিতে অনুভূতিগুলো শুকনো হয়ে গেলেও ছুটিতে যখন দেশে যায় স্কুলের মাঠ, স্কুলের পাশে হালদা নদী, প্রকৃতি, জ্যোৎস্না আমায় এখনো হাতছানি দেয়। ২০০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত যত পরিবর্তন হয়েছে ঘুরে ঘুরে দেখেছি; আর খুঁজে ফিরেছি পুরনো সব স্মৃতি সাক্ষী। বারে বারে শ্বাস নিই আর অনুভব করার চেষ্টা করি লুকিয়ে থাকা স্মৃতিগুলো।

ওমর ফারুক হিমেল, দক্ষিণ কোরিয়ার ইনছন থেকে