
ভূমিকম্প পৃথিবীর প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ। কয়েক সেকেন্ডের কম্পনে কোটি কোটি টাকার সম্পদ ধ্বংস হতে পারে, ঘটতে পারে হাজার হাজার এমনকি লাখো মানুষের প্রাণহানি। বিশেষ করে ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে অবকাঠামো ও জনসংখ্যার ঘনত্ব যত বেশি, ক্ষতির মাত্রাও তত গুরুতর হয়। দক্ষিণ এশিয়া ভৌগোলিকভাবে এমন একটি অঞ্চল, যেখানে ভূমিকম্পের ঝুঁকি সর্বদা বিরাজমান। ভারতীয় উপমহাদেশের টেকটোনিক প্লেট, হিমালয় পর্বতশ্রেণীর ক্রমাগত উত্থান এবং মিয়ানমার ও আন্দামান অঞ্চলের ভূ-গঠনের কারণে এ অঞ্চলের দেশগুলো বারবার ভূমিকম্পের মুখোমুখি হয়েছে। বাংলাদেশও এই ঝুঁকি থেকে বাদ যায় না। বরং ভৌগোলিক অবস্থান, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও জনসংখ্যার চাপের কারণে বাংলাদেশের জন্য ভূমিকম্প একটি বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় ভূমিকম্প ঝুঁকির ভূ-প্রেক্ষাপট
দক্ষিণ এশিয়ার ভূমিকম্প ঝুঁকিকে বোঝার জন্য প্রথমে এর ভূতাত্ত্বিক কাঠামো বুঝতে হবে। ভারতীয় টেকটোনিক প্লেট উত্তর দিকে সরে গিয়ে ইউরেশীয় প্লেটের সঙ্গে ধাক্কা খাচ্ছে। এই সংঘর্ষের ফলে হিমালয় পর্বত সৃষ্টি হয়েছে এবং এখনও সেই চাপ অব্যাহত রয়েছে। এর পাশাপাশি বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে মিয়ানমার ও আন্দামান সাবডাকশন জোনে ভূমিকম্পের আশঙ্কা সবসময় থাকে।
প্রধান ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলসমূহ
হিমালয় অঞ্চল: নেপাল, ভুটান ও ভারতের উত্তরাংশে হিমালয়ের পাদদেশে তীব্র ভূমিকম্প প্রায়শই দেখা যায়। ২০১৫ সালের নেপাল ভূমিকম্পে প্রায় ৯,০০০ মানুষ মারা যায় এবং লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল: আসাম, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম ও মণিপুরে ভূমিকম্প প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। এ অঞ্চলকে বিশ্বে “Seismic Zone V” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
মিয়ানমার ও আন্দামান অঞ্চল: সাবডাকশন জোনের কারণে এখানে বড় মাত্রার ভূমিকম্প প্রায়ই ঘটে থাকে।
পাকিস্তান ও আফগানিস্তান সীমান্ত অঞ্চল: ২০০৫ সালের কাশ্মীর ভূমিকম্পে প্রায় ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।
এইসব ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয় যে, দক্ষিণ এশিয়া ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে বিশ্বে অন্যতম।
বাংলাদেশের ভূমিকম্প ঝুঁকি
বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে তিন দিক থেকে ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে—উত্তরে হিমালয় অঞ্চল, পূর্বে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও মিয়ানমার, এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরীয় সাবডাকশন জোন। এ তিনটি অঞ্চলই ভূমিকম্প উৎপাদনের প্রধান উৎস হিসেবে পরিচিত।

ভূমিকম্প অঞ্চলভিত্তিক বিভাজন
বাংলাদেশ ভূমিকম্প ঝুঁকির ভিত্তিতে তিনটি জোনে বিভক্ত
জোন-১ (উচ্চ ঝুঁকি): সিলেট, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা।
জোন-২ (মধ্যম ঝুঁকি): ঢাকা, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও রাজশাহীর কিছু অংশ।
জোন-৩ (কম ঝুঁকি): খুলনা, বরিশাল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল।
ইতিহাসে ভূমিকম্প
বাংলাদেশের ভূমিকম্প ইতিহাস দীর্ঘ হলেও সেগুলো নিয়ে জনসচেতনতা তুলনামূলক কম। কিছু উল্লেখযোগ্য ভূমিকম্পের মধ্যে আছে-
১৮৯৭ সালের মহাভূমিকম্প (গ্রেট আসাম আর্থকোয়েক): ৮.৭ মাত্রার এই ভূমিকম্প আসামে উৎপত্তি হয়ে সিলেট, শিলং ও বাংলার উত্তরাঞ্চলে ভয়াবহ ক্ষতি করে। শুধু সিলেটেই শত শত মানুষ মারা যায় এবং শহরের বহু স্থাপনা ধ্বংস হয়। নদী ও খালে ফাটল সৃষ্টি হয়ে নতুন জলাশয় তৈরি হয়েছিল।
১৯১৮ সালের ভূমিকম্প: এ ভূমিকম্পের কেন্দ্রবিন্দু ছিল আসাম-সিলেট সীমান্তে। ঢাকায় প্রায় সব বহুতল ভবন ফাটল ধরেছিল। শহরের বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ে।
১৯৩০ ও ১৯৫০-এর দশক: সিলেট ও চট্টগ্রামে মাঝারি মাত্রার একাধিক ভূমিকম্পে ঘরবাড়ি ধসে পড়ে, বহু মানুষ হতাহত হয়।
১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিকম্প: ৬.১ মাত্রার এই ভূমিকম্প বান্দরবান ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি করেছিল।
২০০৩ সালের সিলেট ভূমিকম্প: তুলনামূলক ছোট হলেও শহরের বহু পুরোনো ভবনে ফাটল দেখা দেয়।
২০২১ সালের সিলেট ভূমিকম্প: টানা কয়েক মাস ছোট-বড় কম্পনে শহরবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
এই ইতিহাস প্রমাণ করে, বাংলাদেশে ভূমিকম্প নতুন কিছু নয়; বরং যেকোনো সময় বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে।

কেন বাংলাদেশ বেশি ঝুঁকিতে
বাংলাদেশের ভূমিকম্প ঝুঁকি শুধু ভৌগোলিক কারণে নয়, বরং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও কাঠামোগত নানা কারণে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
ঘনবসতি: বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। ঢাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ বাস করে। এমন ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ভবন ধস ঘটলে উদ্ধারকাজ দুরূহ হয়ে পড়ে।
অপরিকল্পিত নগরায়ণ: ঢাকার মতো শহরে বহুতল ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড মানা হয় না। গলিপথ সরু, খোলা মাঠের অভাব, এবং বস্তি ও আধা-পাকা ঘরবাড়ি ভূমিকম্পের ক্ষতি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।
দুর্বল অবকাঠামো: অনেক স্কুল, হাসপাতাল ও সরকারি ভবনও ভূমিকম্প-সহনশীল নয়। এমনকি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাও ভেঙে পড়ার ঝুঁকিতে আছে।
প্রস্তুতির ঘাটতি: জনসাধারণের মধ্যে ভূমিকম্প বিষয়ে সচেতনতা সীমিত। বেশিরভাগ মানুষ জানে না ভূমিকম্পের সময় কী করতে হবে। উদ্ধার সংস্থা ও ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতাও সীমিত।
ভৌগোলিক দুর্বলতা: সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য এলাকায় মাটির গঠন নরম হওয়ায় সামান্য কম্পনেও বেশি ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
এই সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশে ভূমিকম্প এক প্রকার “মেগা-ডিজাস্টার” হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
সম্ভাব্য ক্ষতির চিত্র
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে আসছেন, যদি ঢাকায় ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে তবে-
অন্তত ৩ লাখ মানুষ প্রাণ হারাতে পারে, আরও কয়েক লাখ আহত হতে পারে।
ঢাকার প্রায় ৭০% ভবন ধসে পড়তে পারে বা অচল হয়ে যেতে পারে।
শহরের সড়কগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলে উদ্ধার কার্যক্রম কয়েক দিন বিলম্বিত হতে পারে।
গ্যাস পাইপলাইন ফেটে ব্যাপক অগ্নিকাণ্ড ছড়িয়ে পড়বে। পানির লাইন ভেঙে পড়ায় আগুন নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হবে।
হাসপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্রগুলো নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় আহতদের চিকিৎসা দেওয়া যাবে না।
বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে দেশব্যাপী অর্থনৈতিক অচলাবস্থা দেখা দেবে।
গ্রামীণ এলাকায় কাঁচা ঘরবাড়ি ধসে পড়ে ব্যাপক বাস্তুচ্যুতি ঘটবে, কৃষি ও জীবিকার ক্ষতি দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলবে।
এক কথায়, বড় ধরনের ভূমিকম্প ঘটলে বাংলাদেশে মানবিক বিপর্যয়, অর্থনৈতিক ক্ষতি ও সামাজিক স্থিতিশীলতা—সবকিছু হুমকির মুখে পড়বে।


ঝুঁকি মোকাবিলা ও প্রস্তুতি
বাংলাদেশে ভূমিকম্প ঝুঁকি কমাতে হলে বহুমাত্রিক পদক্ষেপ নিতে হবে।
১. ভূমিকম্প-সহনশীল অবকাঠামো
নতুন ভবন নির্মাণের সময় বিল্ডিং কোড কঠোরভাবে মানতে হবে।
পুরোনো ভবনগুলো ধাপে ধাপে পুনর্নির্মাণ বা সংস্কার করতে হবে।
২. নগর পরিকল্পনা
রাজধানী ও বড় শহরগুলোতে জনসংখ্যার চাপ কমাতে বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন।
ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় উঁচু ভবন নির্মাণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
৩. জনসচেতনতা
স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ভূমিকম্প মহড়া আয়োজন করা উচিত।
গণমাধ্যমের মাধ্যমে মানুষকে জরুরি পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।
৪. জরুরি সেবা ও অবকাঠামো
ফায়ার সার্ভিস, সিভিল ডিফেন্স ও স্বাস্থ্যসেবাকে শক্তিশালী করতে হবে।
ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধার কার্যক্রমে সেনাবাহিনী ও অন্যান্য বাহিনীকে প্রশিক্ষিত করতে হবে।
৫. আঞ্চলিক সহযোগিতা
ভূমিকম্প কোনো জাতীয় সীমারেখা মানে না। তাই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান, যৌথ মহড়া ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা বাড়াতে হবে।
শেষকথা
দক্ষিণ এশিয়া ভূমিকম্প ঝুঁকিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। নেপাল, ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার—সব দেশই বারবার এর শিকার হয়েছে। বাংলাদেশও তিন দিক থেকে ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। ঘনবসতি, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও দুর্বল অবকাঠামোর কারণে বাংলাদেশে ক্ষতির আশঙ্কা আরও বেশি। তাই এখনই যদি যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ না করা হয়, তাহলে একটি বড় ভূমিকম্প বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। সঠিক নগর পরিকল্পনা, ভূমিকম্প-সহনশীল নির্মাণকাজ, জনসচেতনতা ও আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে এ ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব।








































