
শীতকাল মানেই আরামদায়ক সোয়েটার, গরম কফি আর ফ্যাশনেবল বুট বা স্নিকার্স। কিন্তু আরামের এই পথে কাঁটা বিছিয়ে দেয় একটি মারাত্মক সমস্যা—মোজার দুর্গন্ধ! বন্ধ জুতা, মোটা মোজা আর কম ধোয়ার প্রবণতা—এই তিনের ককটেল যেন পায়ে ব্যাকটেরিয়ার ফার্ম তৈরি করে ফেলে। কেন শীতে এই গন্ধের সমস্যা আরও তীব্র হয়ে ওঠে এবং কীভাবে মাত্র দুই দিনে এই অস্বস্তি থেকে মুক্তি মিলবে, তা নিয়েই থাকছে কিছু পরামর্শ।
কেন শীতে মোজার দুর্গন্ধ আরও অসহ্য হয়ে ওঠে?
অনেকের ধারণা, শীতে যেহেতু ঘাম কম হয়, তাই দুর্গন্ধও কম হওয়া উচিত। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি একটি ভুল ধারণা। শীতে সমস্যা কমার বদলে আরও বাড়ে তিনটি প্রধান কারণে। প্রথমত, ঠান্ডা আটকাতে আমরা এমন জুতা পরি যা প্রায় বায়ু-নিরুদ্ধ। পায়ে সামান্য ঘাম হলেও তা জুতার ভেতরেই আটকে থাকে। এর ফলে জুতার ভেতরে উষ্ণ ও আর্দ্র গ্রিনহাউস এফেক্ট তৈরি হয়—যা দুর্গন্ধ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়ার বংশবৃদ্ধির জন্য আদর্শ। দ্বিতীয়ত, উলের বা সিনথেটিক কাপড়ের মোটা মোজা পরা হয় ঠান্ডা আটকাতে। এই ধরনের ফেব্রিকগুলি ঘাম শোষণ করে না, বরং ধরে রাখে, যা ব্যাকটেরিয়াকে দ্রুত বৃদ্ধির সুযোগ করে দেয়। তৃতীয়ত, কাজের জায়গায় বা ভ্রমণে শীতে আমরা বুট বা স্নিকার্স দীর্ঘ সময় ধরে পরে থাকি। ঘাম শুকানোর কোনও সুযোগ না পাওয়ায় গন্ধের তীব্রতা বাড়ে।

মোজার গন্ধ দূর করার ৭টি অব্যর্থ প্রতিকার:
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী, আপনার দৈনন্দিন অভ্যাসে সামান্য পরিবর্তন এনেই এই সমস্যা থেকে দ্রুত মুক্তি পেতে পারেন।
মোজা নির্বাচনে কৌশল: শীতকালে মোজা নির্বাচনে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। সুতির মোজা এড়িয়ে চলুন! কারণ সুতির মোজা ঘাম টেনে নিলেও তা সহজে শুকাতে পারে না। তার বদলে উলের, বাঁশের বা সিনথেটিক ব্লেন্ডের মোজা ব্যবহার করুন, যা ঘাম টেনে বাইরে বার করে দিতে সাহায্য করে। লাইফস্টাইল বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হলো, কোনোভাবেই একই মোজা পরপর দু’দিন পরবেন না। প্রতিদিন একজোড়া মোজা ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক।

সঠিক পা ধোয়ার পদ্ধতি: প্রতিদিন বাইরে থেকে ফিরে ঠাণ্ডা পানিতে পা ভালোভাবে ধুয়ে সাবানমুক্ত করে শুকনো তোয়ালে দিয়ে আলতো করে মুছে নিন। তবে পা মোছার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, পা পুরোপুরি শুকানোর পর আঙুলের ফাঁকে সামান্য অ্যান্টি-ফাঙ্গাল পাউডার বা বেবি পাউডার ব্যবহার করা। এটি আর্দ্রতা শোষণ করে ব্যাকটেরিয়াকে জন্মাতে বাধা দেবে।
টি ব্যাগ: জুতার ভেতরে টি ব্যাগ রেখে দিন। এটি ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে বাঁধা দেয়। প্রথমে ফুটন্ত পানিতে টি ব্যাগ কয়েক মিনিট রেখে দিন। এরপর এটিকে তুলে ঠান্ডা হলে জুতার মধ্যে রেখে দিন এক ঘণ্টা। এরপর টি ব্যাগটি ফেলে দিন। জুতার দুর্গন্ধ নিয়ে আর ভাবতে হবে না।

কমলার খোসা: জুতার দুর্গন্ধ দূর করতে জুতার মাঝে কয়েকটি কমলার খোসা সারারাত রেখে দিন। কমলার খোসা সমস্ত দুর্গন্ধ শুষে নিবে। ব্যবহারের পূর্বে খোসাগুলো ফেলে ব্যবহার করুন।
ডাবল মোজা কৌশল ও বাতাস লাগানো: যদি খুব ঠান্ডা থাকে, তাহলে জুতার ভেতরে একটি পাতলা সিনথেটিক মোজা এবং তার ওপরে উলের মোজা পরার কৌশল নিতে পারেন। এটি ঘামকে দ্রুত সরিয়ে দেবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, সুযোগ পেলে কাজের ফাঁকে মাঝে মাঝে জুতা খুলে পা-কে ৫ মিনিটের জন্য বাতাস লাগানোর সুযোগ দিন, যা ঘাম দ্রুত শুকিয়ে দিতে সাহায্য করবে।
ফেব্রিক সফেনার সিট: জুতার দুর্গন্ধ দূর করার আরও একটি সহজ ও কার্যকরী উপায় হচ্ছে ফেব্রিক সফেনার সিট। সারারাত এক টুকরো ফেব্রিক সফেনার সিট (fabric softener sheet) জুতার মধ্যে রেখে দিন। এরপর সিটটি বের করেই জুতাটি ব্যবহার করতে পারবেন!
বেবি পাউডার: বেবি পাউডার জুতার দুর্গন্ধ দূর করতে বেশ কার্যকর। জুতা পায়ে দেয়ার আগে কিছুটা পাউডার ছিটিয়ে নিন। তবে এক্ষেত্রে খেয়াল রাখবেন পাউডার যেন বেশি না হয়।
প্রাকৃতিক ও ঘরোয়া কিছু টিপস
মোজা ধোয়ার সময় কুসুম গরম পানিতে সামান্য লবণ মিশিয়ে তাতে কয়েক মিনিট মোজা ডুবিয়ে রাখতে হবে । লবণ ছত্রাকের সংক্রমণ কমায় ফলে ঘামের কারণে পায়ে সৃষ্টি হওয়া ছত্রাক নাশ হয়। লবণ যুক্ত পানিতে পা ডুবিয়ে রাখলে ধীরে ধীরে এই সমস্যার সমাধান মেলে।
বেইকিং সোডা ও লেবু খুব কার্যকর। দুই চা-চামচ বেইকিং সোডার সাথে এক চামচ লেবুর রস যোগ করে ভালো মতো পায়ে মালিশ করে নিতে হবে। এটা স্ক্রাবের কাজ করে। এরপর পা ভালো মতো ধুয়ে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করতে হবে।
ভিনিগার পায়ের দুর্গন্ধ দূর করতে উপকারি। একটা বড় পাত্রে গরম পানিতে কয়েক চামচ ভিনিগার মিশিয়ে তাতে পা ডুবিয়ে বসে থাকতে হবে। নিয়মিত ব্যবহারের ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে।
পায়ের দুর্গন্ধ দূর করতে ল্যাভেন্ডার তেল, টি ট্রি তেল, পেপারমিন্ট বা লেবুর এসেনশল তেল কার্যকর। পায়ে ব্যবহারের ক্রিমের সাথে দুয়েক ফোঁটা এসেনশল তেল মিশিয়ে ব্যবহার করা আর্দ্রতা রক্ষার পাশাপাশি দুর্গন্ধ কমাতেও সহায়তা করে।
পায়ের ঘাম প্রতিরোধ করতে আর্দ্র রাখা জরুরি। তাই বাইরে যাওয়ার আগে ‘অ্যান্টিব্যাক্টেরিয়াল’ উপাদান সমৃদ্ধ ক্রিম বা ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা উপকারী।
জুতার যত্ন: ব্যাকটেরিয়া ও ঘাম দূর করার কৌশল
জুতার ভেতরে জমে থাকা ঘাম এবং আর্দ্রতা দুর্গন্ধের প্রধান উৎস। তাই মোজার গন্ধ কমাতে জুতার পরিচর্যাও আবশ্যক।
জুতাকে বিশ্রাম দিন: কখনোই পরপর দু’দিন একই জুতা পরা উচিত নয়। প্রতি জোড়া জুতাকে ব্যবহারের পর অন্তত ২৪ ঘণ্টা বিশ্রাম দিন, যাতে জুতার ভেতরের আর্দ্রতা পুরোপুরি শুকিয়ে যেতে পারে।
ভিনিগার স্প্রে: ভিনিগারের অ্যাসিটিক অ্যাসিড দুর্গন্ধ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলে। একটি স্প্রে বোতলে পানি ও সাদা ভিনিগার (সমান অনুপাতে) মিশিয়ে রাতে জুতার ভেতরে ভালোভাবে স্প্রে করুন। পরদিন জুতা পরার আগে অবশ্যই তা রোদ বা বাতাসে শুকিয়ে নিতে হবে।
বেকিং সোডা ব্যবহার: রাতে এক চামচ বেকিং সোডা বা দুটি শুকনো টি ব্যাগ জুতার ভেতরে রেখে দিন। বেকিং সোডা বা টি ব্যাগগুলি আর্দ্রতা টেনে নেয় এবং দুর্গন্ধের তীব্রতা কমিয়ে দেয়। পরদিন সকালে পরার আগে এটি ফেলে দিলেই হবে।
মোজা পরার আগে আপনার রুটিনে এই তিনটি সহজ ধাপ অন্তর্ভুক্ত করুন:
পা সম্পূর্ণ শুকিয়ে নিন: মোজা পরার আগে এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। আপনার পা যদি সামান্যও ভেজা থাকে, তবে সেই আর্দ্রতা জুতার ভেতরে আটকে গিয়ে ব্যাকটেরিয়ার দ্রুত বংশবৃদ্ধি শুরু করে।
অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল/শোষক ব্যবহার: মোজা পরার ঠিক আগে পায়ে এমন কিছু ব্যবহার করুন যা ঘাম শোষণ করবে এবং ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি প্রতিরোধ করবে।
অ্যান্টি-ফাঙ্গাল পাউডার: সামান্য অ্যান্টি-ফাঙ্গাল পাউডার বা সাধারণ ট্যালকম পাউডার বা বেবি পাউডার হাতে নিয়ে পায়ের তলায় এবং প্রতিটি আঙুলের ফাঁকে ভালো করে মাখিয়ে নিন। এটি দিনভর অতিরিক্ত ঘাম শুষে নিতে সাহায্য করবে।
কর্নস্টার্চ বা বেকিং সোডা: যদি আপনার কাছে বিশেষ পাউডার না থাকে, তবে সামান্য কর্নস্টার্চ (Cornstarch) বা বেকিং সোডা (Baking Soda) ব্যবহার করতে পারেন। এগুলোও আর্দ্রতা শোষণে অত্যন্ত কার্যকরী।
অ্যান্টিসেপটিক সলিউশনে পা ডোবানো (সপ্তাহে একবার): এটি প্রতিদিন করার প্রয়োজন নেই, তবে সপ্তাহে একবার করলে ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
কীভাবে করবেন: এক বালতি উষ্ণ জলে সাদা ভিনিগার (White Vinegar) বা অ্যাপল সিডার ভিনিগার মিশিয়ে (১ লিটার পানিতে ১ কাপ ভিনিগার) তাতে ১০-১৫ মিনিটের জন্য পা ডুবিয়ে রাখুন। ভিনিগারের অ্যাসিটিক অ্যাসিড পায়ের পিএইচ (pH) ভারসাম্য ঠিক করে এবং দুর্গন্ধ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া মেরে ফেলে। এরপর পা পরিষ্কার জলে ধুয়ে অবশ্যই ভালোভাবে শুকিয়ে নিন।
চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন কখন?
যদি সব ধরনের ঘরোয়া প্রতিকার ব্যবহারের পরেও দুর্গন্ধ না কমে, এমনকি ত্বকে লালচে ভাব, চুলকানি বা ফোসকা দেখা যায়, তবে দেরি না করে চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এটি ‘অ্যাথলিটস ফুট’-এর মতো কোনো ছত্রাক সংক্রমণ হতে পারে, যার জন্য উপযুক্ত চিকিৎসার প্রয়োজন।
তাহলে আর দেরি কেন? আজ থেকেই এই সহজ টিপসগুলো মেনে চলুন এবং এই শীতে মোজার দুর্গন্ধমুক্ত থাকুন!








































