Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

২১ বছরের প্রবাস জীবনের অসমাপ্ত গল্প

আমার বয়স ৪৩। কুয়েতে আছি ২১বছর হলো। জীবনের আর্ধেকটা সময় প্রবাসে চলে গেল। আমার মা বাবা,ভাই বোন, বউ বাচ্চা সবাই বলে আমি নাকি সফল প্রবাসী। আমার পরিবার নাকি গর্ব করে আমাকে নিয়ে। আমার বাবা তো প্রায় বলে আমি নাকি তার শ্রেষ্ট সন্তান। আগে পরিবারের কথা শুনে খুব ভাল লাগতো। নিজেকেই সুখী মনে করতাম কিন্তু এখন কেন জানি আর এই সব কথা শুনতে ভাল লাগে না। খুব বিরক্ত লাগে আর বিরক্ত লাগার কারন হলো বয়সের ভার।

chardike-ad

যাহোক এখন ভাবতাছি দেশে চলে যাবো। দেশে গিয়ে ব্যবসা করবো যে ২৫ লক্ষ টাকা আছে সে গুলো দিয়ে। বাড়ি ঘর তো সবই করলাম। এখন যে টাকা গুলো আছে সেগুলো দিয়ে কিছু একটা করে পরিবারের সাথে থেকে বাকী জীবনটা কাটিয়ে দেব। কিন্তু যখন বাড়িতে বললাম আমি দেশে চলে আসব। তখন আমার কথা শুনে সবাই অবাক হয়ে গেল। হাজারটা প্রশ্ন কেন দেশে আসবো। দেশে এসে আমি কি করবো এমন হাজারটা প্রশ্ন। আমার বাবা তো বলে ফেললেন আমি নাকি দেশে এসে কিছু করতে পারবো না। দেশের অবস্তা নাকি ভাল না। আর আমার দ্বারা দেশে ব্যবসা করাটা অসম্ভব। আমার বউ বলে আপনে এখন দেশে এসে কি করবেন বিদেশ আছেন ভাল আছেন। এখন দেশের ব্যবসায় বাণিজ্য ভাল না। আর এখন নিজের সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে হলেও বিদেশ থাকতে হবে। বাবা আর বউয়ের কথা শুনে অনেক কষ্ট পেলাম।

যে আমি প্রবাসে কাটিয়ে দিলাম ২১ বছর। প্রবাসে প্রতিটি দিনই করতে হয়ে যুদ্ধ। আর সে আমি নাকি দেশে গিয়ে কিছু করতে পারবো না। সবাইকে বললাম কেউ আমার কথা বুঝলে না। সবচেয়ে বেশী কষ্ট পেলাম মা র কথা শুনে। মা বললেন বাবারে তোর মত সহজ সরল মানুষেরা দেশে এসে কিছু করতে পারবি না। এই দেশটা ভাল মানুষের জন্য নয়। যতদিন বিদেশে থাকতে পারিস ততদিন ভাল থাকবি। অথচ আমি অপরিচিত দেশে ভিন্ন ভাষা মানুষের সাথে বছরের পর বছর কাটিয়ে দিলাম। একজন সফল প্রবাসী বটে। অনেক টাকা পয়সা রোজগার করলাম।

এই আমি নাকি নিজ দেশে গিয়ে কিছু করতে পারবো না। খুব জানতে ইচ্ছে করে যারা দেশে আছে তারা কি বেঁচে থাকে না। তারা কি না খেয়ে থাকে। হয়তো তাদের সংসারে বিলাসিতা নেই, নেই দামি দামি খাওয়া, দামি পোশাক। তবু তো তারা বেঁচে থাকে। হয়তো দেশে থাকলে জীবন যুদ্ধটা একটু কঠিন।

যদি আমার গল্পটা এখানে সমাপ্তি হলে ভালই হতো। কিন্তু প্রবাসীদের একটি গল্পে পর অরেকটি গল্প শুরু হয়। আর এই গল্পের সমাপ্তি করতে গিয়ে জীবন থেকে চলে যায় অনেক গুলো বছর। সবকিছু ভুলে মেনে নিলাম পরিবারের সিদ্ধান্তকে। কারণ বাঙ্গালিরা পরিবারবিহীন থাকতে পারে না।

হঠাৎ একদিন বাবা বললো বাড়িতে বিল্ডিং তৈরীর জন্য। আমি বললাম বিল্ডিং তোলার টাকা কই পাবেন। তখন বাবা বললো কেন ব্যাংকে যে টাকা জমা আছে ঐগুলো দিয়ে। ব্যাংকের টাকা গুলো না হলে কয়েক লাখ টাকা ঋণ করবো। তুই মাসে মাসে ঋণ শোধ করবি। আমি বললাম না বাবা বিল্ডিং করার দরকার নাই। যদি বিল্ডিং তুলেন তাহলে যে আমার বাকি জীবনটাই প্রবাসে কাটাতে হবে। তখন বাবা বললো আমার অনেক দিনের ইচ্ছে বিল্ডিং এ ঘুমানো।

এদিকে বউ একই কথা বলছে। মাও বলছে পাশের বাড়ি অনেকেই বিল্ডিং করছে। তুই কেন করবিনা। আমার ছোট ছোট ছেলে মেয়ে থেকে শুরু করে বাড়ি সবাই বলছে বিল্ডিং করার জন্য। বিল্ডিং করলে নাকি সমাজে মানুষের কাছে দাম পাওয়া যায়। সমাজে বড় লোক হিসাবে পরিচিত হওয়া যায়। কিন্তু কেউ আমার কথা শুনলো না।

আমার কষ্টটা কেউ বুঝলো না। আমি জানি বিল্ডিং করতে গেলে আমার আরো ১০ বছর প্রবাসে থাকতে হবে। কারণ যে টাকা গুলো আছে তা বিল্ডিং করতে খরচ হয়ে যাবে। ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের জন্য আরো বাকি জীবনটা প্রবাসে কাটাতে হবে। কিন্তু এই প্রবাস জীবন টা আমার আর ভাল লাগে না। আজ আমি অনেক ক্লান্ত। বয়সের ভারে শরীরের শক্তিগুলো প্রতিনিয়তো ঝড়ে পরছে। এখন আর আগের মত কিছু ভাল লাগে না। কিন্তু কেন আপন মানুষগুলো এত স্বার্থপর হয়। আমিতো চেয়ে ছিলাম বাকি জীবনটা ছোট একটা ঘর তুলে বউ বাচ্চা, মা বাবাকে নিয়ে কাটিয়ে দেব।

আমার চাওয়াগুলো কেন প্রিয় মানুষগুলো বুঝে না। আজ যে আমি অনেক ক্লান্ত। আমি যে পারছি না বয়সের ভারে জীবনটাকে চালিয়ে নিতে। আমি জানি না আরও কত বছর প্রবাসে কাটাতে হবে নাকি মৃত্যু পর্যন্ত। আর তা যদি হয় আফসোস নাই। আমি ও চায় যেন আমার মৃত্যুটা যেন একজন সফল প্রবাসীর হয়। আর তখন পরিবার, সমাজ, দেশ আমাকে একজন সফল প্রবাসী হিসাবে গর্ব করবো।